কুড়িয়ে পাওয়া খাবার খেয়ে জীবনের পরিবর্তন (৩)
রোকেয়া বেগম || Monday 12 December 2016 ||নাম: রং বাহার বয়স ৫৬ বছর গ্রাম: গোয়ারিয়া স্বামী; মৃত আনোয়ার হোসেন
তিন ডিসিমল জায়গার উপরে বাপের বাড়ি সেখানে ভাইয়েরা একটি ঘর উঠানোর জায়গা দিয়েছে। চার চালা একটি পুরানো ঘর আছে।
পরিবারের সদস্য সংখ্যা আগে ছিল ৪ জন। এখন নিজে একা থাকেন। মা মারা গেছে। মেয়ে বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ি চলে গেছে। নাতী আমার কাছে থেকে লেখা পড়া করতো সে এখন থাকেনা।
রং বাহার বলেন, আমি বাপের বাড়িতে থাকি। ভাইরা আলাদা থাকে আমি আলাদা থাকি। আগে মানুষ বেশি ছিল চাল বেশি লাগতো। এখন একদিনের জন্য আমার আধা কেজি চালের ভাত লাগে। আগে সকালে উঠে চাল পানি খেয়ে চকে (জমিতে) শাক তুলতে যেতাম। এই মৌসুমে শাক কম একটু বৃষ্টি হলে অনেক শাক হবে। ঘরে মিষ্টি আলু আছে ঐ আলু বোনলে শাক হবে কার্তিক মাসে সেই শাক খাব।
সকালের খাবার
আজ সকালে মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, সেঞ্চি শাক, পুইশাক পাতা, একত্রে ভাজি করেছি। গতকাল পুকুর সেচে দাড়কিনা মাছ পেয়েছি সেই মাছ দিয়ে ধুমড়া (ধুন্দুল) রান্না করেছি।
দুপুরের খাবার
ঘরে কিছু গমের ছাতু আছে চিনি সাজ দিয়ে (বৈশাখ মাসে সাজ কিনে ছিল) দুপুরে সেই চিনি সাজ দিয়ে ছাতু খাব।
রাতের খাবার
কার্তিক মাসে মাছ ধরে শুটকি করে রাখি সারা বছর অল্প অল্প শুটকি দিয়ে তরকারি রান্না করি ও শুটকির ভর্তা খাই। রাতে শুটকি মাছ দিয়ে কচুর ডাটা রান্না করবো। বেগুন ভর্তা করবো। ভাইয়েরা গোল আলু বোনে আবার অন্যের জমিতে ১ মন আলু তুলে দিলে ৫ কেজি আলু দেয়। সারা বছর অল্প অল্প করে ঐ আলু খাই। কলমি শাক, দন্ড কলস ভর্তা, দন্ড কলস বড়া, ঢেকি শাক, তেলাকুচা, খুইদা মনকন বড়া (থানকুনি)কলার কাঞ্জাল, কলার থোর চেয়ে এনে খাই।
মন্তব্য: রংবাহার বলেন আগের চেয়ে আমি অনেক ভাল আছি। আগে আমার স্বাস্থ্য অনেক খারাপ ছিল এখন স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। আমার বাড়ির চারি পাশে কুড়িয়ে পাওয়া বিভিন্ন জাতের শাক আছে। এখ খড়া তাই শাক কম একটু বৃষ্টি হলেই আবার সব শাক গজাবে।
সুফিয়া বেগম, বয়স ৪৯ বছর, গ্রাম: গোয়ারিয়া
সুফিয়া বেগম, স্বামী মৃত আব্দুল আজিজ। ৩৪ ডিসিমল জায়গায় তার বাড়ি। ৭ লাখ টাকা ঋণ করে বড় ছেলে মেঝ ছেলেকে সিংগাপুর পাঠিয়ে ছিল। ১ বছর ছিল এক বছরে ৪ লাখ টাকা পাঠায়েছে। এখন ও তিন লাখ টাকা ঋণ আছে। এখন চাকরি নাই দেশে ফিরে এসেছে। প্রশিক্ষণ নিতেছে আবার বিদেশ যাবে। আগে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ জন। ৩ ছেলে ২ মেয়ে দুই মেয়ে বিয়ে হয়েছে ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। বর্তমানে পরিবারের সদস্য ২ জন। সুফিয়া বেগম, তার এক ছেলে প্রতিবন্ধী তাকে নিয়ে থাকেন। সুফিয়া বেগম বয়স্ক ভাতা পান ৪ মাস পর পর ১২০০ এই টাকা দিয়ে কোন রকম তার সংসার চলে। বাজার থেকে তেমন কিছু কিনে খেতে হয় না। প্রতিদিন এক বেলা রান্না করে দুই বেলা খান। ছেলে তিন বেলা খেলেও তিনি দুই বেলা খান কারণ হিসেবে জানান তার প্রেসার আছে তাই কম খান। আজকে ভাত একটু বেশি রান্না করেছেন তিন বেলা চলবে। কিনে তরকারি খুব কম খান। কুড়িয়ে পাওয়া শাক বেশি খান।
সাক্ষাতকার নেয়ার দিন সকালে ঘরে কেনা ধানের চাল করা ছিল সেখান থেকে তিন পোয়া চালের ভাত রান্না করেছেন। ডাল ভর্তা, দুধ কচু পাতার ভর্তা, ঢেড়শ ভর্তা করেছেন। এই তরকারি ছিল নিজের বাড়িতে বোনা। ডাল বাজার থেকে কেনা। শরীর ঠান্ডা থাকার জন্য মাঝে মাঝে রাতে রসা ও ঝোল ঝোল তরকারি খায়।
এই মৌসুমে বাড়িতে যে সব শাক সবজি চাষ করেছেন ধুরমা (ধুন্দুল) শসা, ঢেঁড়শ, চাল কুমড়া, দেশী লাউ, পুই শাক, বড়বটি, ১০/১২ টি মরিচের গাছ আছে সারা বছর এই মরিচে চলে যায়। রসুন, পেঁয়াজ, হলুদ, ধনিয়া কিনে খেতে হয়। বাকী সব কুড়িয়ে খান। সারা বছর কুড়িয়ে পাওয়া শাকের মধ্যে হেলেঞ্চা, কলমি, পাট শাক, অজাত কচু, কচুর লতি, কচুর মুখি, কলার কাঞ্জাল, কলার থোর, দণ্ড কলস, পিপুল পাতা মরা মাছ দিয়ে রান্না করেন, ফুল সেঞ্চি, বর্ষাকালে শাপলা, শালুক কুড়িয়ে আনেন। ছেলেরা বর্ষার সময় খোয়া জাল দিয়া মাছ ধরে তা মাকে দেয়। দাড়কিনা, ইচা, মলা, চান্দা, চাটা (খলিশার চাইতে ছোট যে মাছ) কাইকা এই সব মাছ পায়।
রোজার সময় সন্ধ্যা রাতে ভাত রান্না করে রাখেন সেই ভাত সেহেরীতে খান। ইফতারিতে বাসি ভাতের সাথে মুড়ি মাখিয়ে খান। কোন দিন শুধু বাসি ভাত খান। ছেলের বউরা ছোলা করলে দেয় তা ইফতার করেন।
মন্তব্য: সুফিয়া বেগমের একদিনের খাবারের মধ্যে কেনা চাল ছাড়া সবই তার বাড়ির পাশে নামা জায়গায় চাষ করা সবজি ।
কুলসুম বেওয়া, বয়স ৬৭ বছর, গ্রাম: কান্দাপাড়া
কুলসুম বেওয়ার দুই ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলে বিয়ে করে আলাদা খায়। এখন তার পরিবারে সদস্য ২ জন। ছোট ছেলে তার সাথে থাকে। তার মাঠে জমাজমি নাই। বাড়ি ভিটায় ৬ ডিসিমল জায়গার উপর একটি দুচালা ঘর তুলে থাকছেন। একটি মুরগী ও একটি হাঁস বর্গা পালেন। আড়াইলাখ টাকা ঋণ করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। ৫ বছর হয় ছেলে দুবাই গেছে। অন্যের কাছ থেকে যে টাকা ঋণ করে ছিলেন তা শোধ করে দিয়েছেন। ২ লাখ টাকার উদ্ধারী জমি নিয়ে বর্গা দিয়ে রেখেছেন। ঐ জমিতে ইরি ধান চাষ করে বর্গাদার অর্ধেক ধান দেয় । ১৫/১৬ মন ধান পান। সারা বছর এই ধানে তার চলে যায়। কিনে খেতে হয় না। নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় পুইশাক, চালকুমড়া বুনেছেন।
হেলেঞ্চা ও কলমি, কচু শাক, কলার থোর, কলার মোচা, লাউ পাতা কুড়িয়ে আনেন। চাল কুমড়া পাতা নিজের বাড়িতে আছে তা ভাজি করে খান। সব মৌসুমে বাড়িতে সবজি গাছ লাগান। মাঝে মাঝে বাজার থেকে সবজি ও মাছ কিনতে হয়। সাক্ষাতকার নেয়ার দিন সকালে কিছু রান্না করেনি। ছেলের বাড়িতে খরের পালা দিয়েছে ছেলের ঘরে ভাত খাবে চাল কুমড়া ভাজি দিয়ে। কুলসুম বেওয়া বলেন রাতে কি খাব জানি না। ঘরে কোন তরকারী নাই। বাজার থেকে গোল আলু কিনে আনবো।
উদাহরণ ৪: কৃষক জোসনা বেগম, একটি কৃষক পরিবারের খাদ্য তালিকা
নাম: জোসনা বেগম, বয়স ৩৫ বছর। স্বামীর নাম আশরাফ আলী গ্রাম: মৌসাকাটালিয়া
পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। অনেক কষ্ট করে ছেলেদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। ভাড়ি ভিটা ছাড়া তার কোন জমি জমা নাই। সামান্য জমি ছিল তা বিক্রি করে স্বামীকে দুবাই পাঠিয়েছেন। জোসনা বেগমর দুই ছেলে এক মেয়ে। ৬ বছর হয় স্বামী বিদেশ গেছে। ২ মাস পর পর টাকা পাঠায় ১০/১২ হাজার টাকা। ধানের সময় জোসনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। ১ মাস কাজ করলে ২ মন ধান, একটি ব্লাউজ, একটি শাড়ি, একটি পেটিকোট দেয়।
আগে গমের রুটি খেতেন ভাতের চেয়ে গমে বেশি খরচ হয় তাই রুটি খান না। একদিনে দেড় কেজি চালের ভাত লাগে। কুড়িয়ে পাওয়া শাক বেশি খান ঢেকি শাক, মোরগ শাক, ন্যাটাপেটা, কলমি, হেলেঞ্চা। সাক্ষাতকার নেয়ার দিন সকালে জোসনা তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়েছেন। দুপুরে আতপ চালের খুদ দিয়ে চাপড়ি খেয়েছেন। বিষা চাচার কাছ থেকে ঢেড়স চেয়ে এনেছেন। দুপুরে ঢেড়স ভর্তা করবে। খালার কাছ থেকে গোল আলু চেয়ে এনেছেন ডিম দিয়ে রান্না করবেন। এই তরকারি রাতেও খাবে। রাত্রে আধা কেজি চালের ভাত রান্না করবেন। রান্নার জ্বালানী হিসেবে সব কুড়ানো। নাড়া, ধানের মোথা, গোবড়, ধইঞ্চা, তিলের ডাটা, পাট খড়ি, পাতা।
চাম্পা বেগম, গ্রাম: গজিয়াবাড়ি
চাম্পা বেগমের বয়স ৫১ বছর। লেখাপড়া জানেন না। স্বামীর নাম: আব্দুস ছামাদ। স্বামী আগে অন্যের জমিতে কামলা দিত। আব্দুস ছামাদ তিন বছর ধরে পঙ্গু অবস্থায় ঘরে পড়ে আছে। ঢাকায় ইসপাইন অর্থপেডিকস হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করেছে। ডাক্তারা বলেছে বার্জাজ ডিজিজ হয়েছে। বাম পা হাটুর উপর থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। ডান পায়ে পচন ধরেছে। চিকিৎসা করার মত কোন টাকা পয়সা নেই তাই এখন বিনা চিকিৎসায় বাড়িতেই বিছানায় পড়ে আছেন। পরিবারের সদস্য ৪ জন। এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলের বয়স ২৫ বছর ছেলের নাম মেহেদী হাসান রাজু। বাবা সুস্থ থাকা অবস্থায় কামলা দিয়ে ছেলের লেখা পড়ার খরচ বহন করতো। নানা বাড়ি থেকেও লেখা পড়ার কিছু খরচ দিতো। এস এস সি পাশ করার পর গার্মেন্টে চাকুরি পেয়েছে। ছেলের টাকায় এখন সংসার চলে। চাম্পা বলেন, তার বাবার বাড়ি থেকে তাকে ৪ মন ধান দিয়েছে তা সিদ্ধ করেছে শুকিয়ে চাল করে আজ রাতের ভাত হবে। ছেলের উপার্জনের টাকায় বাপের চিকিৎসা খরচ চলছে। মেয়ের বয়স ২২ বছর। এইচ এসএসসি পাশ করে বাড়িতে বসে আছে। চাম্পা বলেন, আমাদের কোন জমি ছিল না বসত বাড়ি ছিল ১০ শতাংশ। বসত বাড়িতে শাক সবজির চাষ করি। এখন ধুন্দুল (ধুমরা) মরিচের চারা একটি, চাল কুমড়া, লাগিয়েছি। এখন ২২ শতাংশ জমি কিনেছি নদীর ধারে। সেখানে কলা চাষ করেছি সবরি কলা, কাঁচ কলা, বিচি কলা আছে। কিন্তু ঐটা দেখার কোন লোক নাই। যত্নের অভাবে কলা কম হয়। আমরা সব সময়ই কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য খাই। আগে কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের কালাই চাষ করতো এখন আমাদের এলাকায় কালাই চাষ কমে যাওয়ায় কুড়িয়ে পাওয়া শাক কমে গেছে। শাপলা, শালুক, কলমি শাক, ভাইতা শাক, হেঞ্চি শাক, ঢেঁকি শাক, তেলাকুচা, শাপলা, শালুক। যে দিনে যেটা পাওয়া যায় তাই তুলে এনে খাই। আগে ঢেপ কুড়াতাম এখন মানুষ ঢেপ হওয়ার আগেই শাপলা তুলে বিক্রি করে তাই ঢেপ পাই না । আগে বাচ্চারা ছোট ছিল তারা কুড়াত। এখন আমি নিজেই কুড়াই। রান্না করার জন্য জাবা খড়ি (জ্বালানী) ও কুড়িয়ে আনা হয়। কলা বাগান থেকে কলার ফেতরা, গরুর গোবড়,নাড়া, বাঁশের মোথা, বাঁশ পাতা, আম পাতা, কাঁঠাল পাতা, অন্যের বাড়িতেগমের সময় গম তুলে দিরৈ গমের ডাটা দেয়, কুড়িয়ে রাখি সারা বছর ঐ জাবা খড়ি দিয়ে রান্না করি। বাড়িতে দুটি দুচালা টিনের ঘর একটি রান্না করার ছাপড়া আছে। একটি মুরগী আছে ৭টি বাচ্চা দিয়েছে । ফলের গাছ পেয়ারা গাছ একটি জাম্বুরা একটি কাঁঠাল গাছ একটি।
সকাল: সকালে অনেক সময় বাসী খাবার খাওয়া হয়। আজ সকালে বাটা মাছ দিয়ে শসা দিয়ে ঝোল রান্না করেছি ঢেড়শের ভর্তা করেছি। শীতকালে সন্ধ্যায় ভাইতা শাক দিয়ে পিঠালু রান্না করে সকালে খাওয়া হয়। ভাত রান্না করলে কচু শাক ভর্তা, তেলাকুচার পাতা বাটা খাওয়া হয়।
দুপুর: আগে মাছ ধরে খেতাম। এখন মাছ ধরার লোক নাই তাই বেশির ভাগ সময় মাছ কিনে খেতে হয়। সকালের তরকারি যা থাকবে তাই দিয়ে দুপুরে খাব। এখন খারকুন পাতা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে দুপুরে খারকুন পাতার ভর্তা খাই। আগে পুঁটি, ইচা, চাটা, বাইম, ভুতকইয়া, টাকি এইগুলি তরকারি ও কলমি শাকের ডোগা দিয়ে রান্না করা হত। ফাল্গুন চৈত্র মাসে দুপুরে কচুরমুখী সিদ্ধ করে ডাল খাওয়া হয়। অনেক সময় ভাইতা ও অন্যান্য শাক খাওয়া হয়।
রাত: রাতের বেলায় আজ কি রান্না করবো এখনো জানি না। শীতকালে বেশী শাক পাওয়া যায় তাই ঐ সময় শাক বেশি খাওয়া হয়। বিকাল বেলায় শাক তুলি সন্ধ্যায় রান্না করা হয়। ভাইতা শাক, হেঞ্চি শাক, ন্যাটাপ্যাটা শাক অন্য সময় তেলাকুচা শাক, কানাই শাক, ঢেপা শাক, বন কচু শাক খাওয়া হয়।