অভিশপ্ত ভবন ও উন্নয়নের মিথ
ফরিদা আখতার || Wednesday 01 November 2017 ||দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি যাদের রক্তে-ঘামে জড়িয়ে আছে, সেই গার্মেন্ট শ্রমিকরা যখন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন, আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকেন, তখন তাদের খবর কেউ রাখে না। রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতির দুই বছর পূর্তিতে এ সত্য আবার আমাদের চোখের সামনে এসে পড়েছে। কোনো আনন্দের ঘটনার বর্ষপূর্তি কাম্য হতে পারে, কিন্তু রানা প্লাজা ধস ও সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং যে হাজার হাজার শ্রমিক ও কর্মী আহত হয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকের হিসাব তালিকা থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছেন, তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমাদের লজ্জায় মাথা নত হয়, বিবেকে আঘাত লাগে। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে খবর পাচ্ছি, তাতে দেখা যাচ্ছে, নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ও আহত শ্রমিকদের সহায়তা পুরোপুরি দেয়া হয়নি। আনুষ্ঠানিকতা অনেক হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক দিক বা অর্জনের কথা বলতে গেলেই গার্মেন্ট শিল্পের রফতানি আয়ের কথা ওঠে। যেমন— ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি হয়েছে গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করে। গার্মেন্ট রফতানির কারণেই মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলারে রফতানির হিসাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের বিলিয়ন ডলার আয়। এ নিয়েই তো দেশের উন্নতির হিসাব। গার্মেন্ট শিল্পের সংখ্যা পাঁচ হাজার এবং শ্রমিক সংখ্যা ৪২ লাখ, যাদের অধিকাংশই নারী। কিছুদিন আগে এক টেলিভিশন টকশোয় দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে, দেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১২ কোটি সেলফোন ব্যবহার করে (৭৭ শতাংশ)। তা-ই যদি হয়, গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকাংশই সেলফোন ব্যবহার করে। অন্তত ৪২ লাখ না হোক, ৪০ লাখ তো হবেই! রানা প্লাজা ধসের সময় যতক্ষণ ফোনে চার্জ ছিল, ততক্ষণ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছে। এর পর অনেকের সেলফোন বেজেছে, কিন্তু তিনি নিজে বাঁচেননি। আর কেউ হয়তো সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তার সেলফোনের ক্রেডিট বা চার্জ শেষ হয়ে গেছে। সেলফোনের সংখ্যা দিয়ে উন্নতির কথা বললে ব্যবহারকারীর উন্নতি কত হয়েছে, তাও বলতে হবে। গার্মেন্ট শ্রমিকরা আজ যে দুঃখ-দুর্দশার শিকার, কয়টি মোবাইল কোম্পানি তাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছে? আমার অন্তত জানা নেই। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারে বসে যারা কাজ করেন, তাদের অবদান যতখানি আছে, তার ফলে আমরা রাস্তায় যানজট দেখি; তারা মোবাইল একটি নয়, দু-তিনটি কেনেন, আবার গাড়িও কেনেন কয়েকটি। রাস্তা ভরে যায়। কিন্তু শ্রমিকের অবদান এদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে এখনো কারখানায় হন হন করে হেঁটে যেতে হয়। তাদের কারণে যানজট হয় না। তারা কষ্ট করে যে আয় করেন, সেই টাকায় গাড়ি আসে বিদেশ থেকে। অমানবিকভাবে পরিশ্রম করে তারা আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য টাকা রোজগার করেন। উন্নয়নের সঙ্গে মানবিকতা কবে আসবে?
শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি পেতে হলে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। তারা ‘সস্তা শ্রমিক’, তাদের আবার এত দাবি কিসের? দীর্ঘদিন গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন চলেছে। মজুরি বাড়ানোর পর আজো যা দেয়া হচ্ছে, তাকে ন্যায্য কতখানি বলা যাবে, সেটা বিবেচনার বিষয়। শ্রমিকরা দাবি করতে গিয়ে একটু আন্দোলন করলে সেটা হয়ে যায় অরাজকতা। তাদের লাঠিপেটা করা হয়, গ্রেফতার করে হয়রানি করা হয়। ভয়ে সাধারণ শ্রমিকরা মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করেন।
কিন্তু তাই বলে তারা যে কারখানায় কাজ করবেন, সেটাও নিরাপদ হবে না? এর সঙ্গে এতগুলো মানুষের প্রাণ রক্ষার সম্পর্ক! ভবন তৈরির সময় যেসব ন্যূনতম বিষয় দেখে অনুমোদন দেয়ার কথা ছিল, তা হয়নি বলেই ভবনটি পড়ে গেছে। রানা প্লাজা ধস তো শ্রমিকের ভারে হয়নি, হয়েছে ভবনের ত্রুটির কারণে। যেমন— জলাশয়ের ওপর বহুতল ভবন তৈরি করা যাবে কিনা, এ ব্যাপারে অনুমোদন না নেয়া; বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের কথা বলে শিল্প-কারখানা নির্মাণ; মূল ভবনের ওপর বাড়তি তিনতলা তৈরি করে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়া— এসব কারণে ধসে গিয়েছিল রানা প্লাজা। তাছাড়া সাধারণ মানুষও বোঝে, এ ভবনে ভারী যন্ত্রপাতি তোলা, বড় বড় জেনারেটর ব্যবহার বিল্ডিংটিকে কাঁপিয়ে তুলত। আগের দিন ফাটল দেখা দেয়ায় শ্রমিকরা যেতে চাননি, তবুও তাদের জোর করে কাজে আসতে বলা হয়েছে। কারণ ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে শিপমেন্টের তাড়া ছিল। ভবনটি ঠিকমতো নির্মাণ করা হলে এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যেত না।
সেসব কথা গত দুই বছরে অনেক আলোচনা হয়েছে। ফলে অবস্থার কিছুটা উন্নতির কথা উঠেছে এবং এ বিষয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ও অনেক মালিকেরও সচেতনতা বেড়েছে। রানা প্লাজা ধসে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ১৪৬ বলা হলেও তার সঙ্গে নিখোঁজের সংখ্যা যুক্ত করলে আরো বেড়ে যাবে। এ সংখ্যা এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। আসলে একপর্যায়ে লাশ খোঁজাও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা অনেক দিন দেখেছি, ভবনটি একেবারে চুরমার করে ফেলা হলেও তার সামনে ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বজনরা। হাড়গোড় পাওয়া গেছে অনেক। ডিএনএ টেস্ট করেও শনাক্ত হয়েছে অজ্ঞাত পরিচয় লাশগুলো, কিন্তু গোনার মধ্যে আর ঢোকেনি। গার্মেন্ট শিল্প শুধু সস্তা শ্রমের কারখানা নয়, এখানে যারা কাজ করেন, তারা বয়সেও তরুণ। ২০ থেকে ৩০-৩৫ বছর বয়সী শ্রমিকরা এখানে কাজ করেন। এদের বেশির ভাগই নারী। তাই রানা প্লাজা ধসের পর যে দৃশ্য চোখে পড়ার মতো ছিল তা হচ্ছে— মা-বাবা, ভাই বা স্বামী এরাই ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর লাশের সারিতে আছে নানা রঙের ছিট কাপড়ের সালোয়ার কামিজ পরা কিশোরী বা তরুণী কিংবা জিন্সের প্যান্ট পরা কোনো তরুণের ছবি। অন্যান্য কারখানায় এ ধরনের দুর্ঘটনায় বিপরীত দৃশ্যই হয়তো চোখে পড়ত। লাশ হতো পুরুষের আর বাইরে আহাজারি করছেন তার সন্তানেরা।
রানা প্লাজা কোনো গার্মেন্ট কারখানার নাম নয়, এখন এর নাম শুনলেই মনে হয় শুধু দুর্ঘটনায় আক্রান্ত একটা ভবন, যে ভবন ধসে গিয়ে এত প্রাণহানি হয়েছে, তারা ছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক। তাই গার্মেন্টের নামের সঙ্গে কলঙ্কিত হয়েছে রানা প্লাজা নামের ভবনটি। যারা বেঁচে আছেন, তাদের হাত-পা কেটে আহত অবস্থায় পঙ্গুত্বের জীবন বয়ে বেড়ানোর জন্য দায়ী একটি বিল্ডিং। রানা প্লাজা একটি অভিশপ্ত বিল্ডিংয়ের নাম।
রানা প্লাজা ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা এ দেশের উদীয়মান একটি শিল্প এবং তার সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিকের কাজ পাওয়া ও কাজ করার আশার আলো নিভিয়ে দিয়েছে। এর আগের বছর তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিক পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া আর তারই সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক কারখানা থেকে বের হতে গিয়ে আহত হওয়া যে বেদনার আঁচড় রেখে গেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া ভুক্তভোগীদের পক্ষে ভোলা কোনোমতেই সম্ভব নয়।
গার্মেন্ট শিল্পকে সস্তা শ্রম, নারী শ্রমিকদের আনুগত্যমূলক স্বভাব এবং দেশের উন্নতির জন্য ব্যাপ ক বৈদেশিক মুদ্রার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সবসময়। আমরা যারা নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলি, তারাও স্বাগত জানিয়েছি। কারণ এর মাধ্যমে একটি মেয়ে নিজের মতো আয় উপার্জন করে জীবন গড়তে পারবে। সে কারো ওপর নির্ভরশীল হবে না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেখেছি, কত মা-বাবা ভাইবোন কাঁদছেন এই বলে যে, তাদের সংসারের খরচ এ মেয়েটিই বহন করত। এমনকি অনেক স্বামীও তার স্ত্রীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তবুও তারা সুখেই ছিলেন। কাজে কষ্ট ছিল, কিন্তু সম্ভাবনাটাই তারা বেশি দেখেছেন।
কারখানায় কাজের পরিবেশ সুষ্ঠু করার দাবি শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিনের। কিন্তু কখনো তা শোনা হয়নি। এর সঙ্গে জড়িত ছিল শ্রমিকের স্বাস্থ্যের বিষয়, ইংরেজিতে যাকে আমরা Occupational Health hazard বলি। দীর্ঘসময় বসে থেকে ঘাড় নিচু করে কাজ করার কারণে ঘাড় ও কোমড় ব্যথা হওয়া; কাজ থেকে ওঠার অনুমতি নেই বলে বাথরুমে যেতে না পারার জন্য ঠিকমতো পানি না খাওয়ার ফলে ইউরিন ইনফেকশন হওয়া; আলো ঠিকমতো না থাকার কারণে চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার তথ্য আগের অনেক গবেষণায় পাওয়া গেছে। এর জন্য কোনো প্রতিকার কখনো হয়নি। শ্রমিকদের কথা কখনই কানে তোলেনি গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। শ্রমিকদের অনেক বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছে ন্যায্য মজুরি ও কাজের পরিবেশের দাবিতে। যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের পোহাতে হয়েছে অনেক নির্যাতন। এগুলো পত্রপত্রিকায় খবর হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাড়া দেয় না; ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সিল দেখে কাপড়ের ক্রেতারা আঁতকে ওঠেন না। কিন্তু একপর্যায়ে যখন ভবনে দাউ দাউ করে আগুন লেগে যায়, শ্রমিকের লাশের সারি দেখা যায়, ভবন ধসে দিনের পর দিন উদ্ধার কাজ চলতে থাকে আর গলিত লাশ বের হয় কিংবা হাত-পা কেটে জীবিত উদ্ধার করা হয়, তখন এই আন্তর্জাতিক মহল আর চুপ করে থাকতে পারেনি। তারা তত্পর হয়েছে কারণ তাদের ব্র্যান্ডের ওপরই এ রক্তের ছাপ পড়ে গেছে, পোড়ার দাগ পড়েছে।
বিল্ডিং ভাঙা ও আগুন লাগার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজের পরিবেশের নিরাপত্তা ঠিক আছে কিনা, তার জন্য দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন— Accord on Fire and Building Safety in Bangladesh (সংক্ষেপে অ্যাকর্ড) ও Alliance for Bangladesh Worker Safety (সংক্ষেপে অ্যালায়েন্স) বাংলাদেশে কাজ করছে। অ্যাকোর্ড মূলত ১৫০টি বিদেশী গার্মেন্ট ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের (বেশির ভাগ ইউরোপের) জোট। তারা এ পর্যন্ত ১ হাজার ১০৩টি কারখানা পরিদর্শন করেছে, নিরাপত্তার দিক ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২৭টি গার্মেন্ট ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের জোট অ্যালায়েন্স ৫৮৪ কারখানা পরিদর্শন করেছে। জাতীয় পর্যায়ে গঠিত হয়েছে সরকার, শ্রমিক প্রতিনিধি ও মালিকদের নিয়ে National Tripartite Plan of Action on Fire, Electrical Safety and Physical Integrity in the Ready Made Garment Sector of Bangladesh (সংক্ষেপে NAP— ন্যাপ)। তারা ৬৪৭টি কারখানা পরিদর্শন করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাদের পরিদর্শনের কারণে প্রায় ৩২টি কারখানা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এবং ২১টি সাময়িক বন্ধ হয়েছে। এতে ১৭ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অর্থাত্ কারখানার ত্রুটি ধরা পড়লে মালিকের পাশাপাশি খেসারত দিতে হচ্ছে শ্রমিককেই। কারণ তাদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা হয়নি।
ঢাকঢোল পিটিয়ে এত উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের গতি হতাশাজনক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ সালে নেয়া ৮০টি চলমান কর্মসূচির মধ্যে মাত্র ১২টি সম্পন্ন হয়েছে, ৪৮টির কাজ চলছে এবং ২০টি প্রকল্প বসে আছে। কাজের উন্নতির মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে, শুধু ২৩৫ জন ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরের নিয়োগ দিয়ে। আগে বলা হতো, যথেষ্ট জনবলের অভাবে কারখানার পরিস্থিতি জানা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে কারখানা পরিদর্শনের জন্য গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি এলাকায় পাঁচটি নতুন কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, জনবলও দেয়া হয়েছে, কাজের প্রয়োজনীয় ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে ফায়ার সার্ভিস গাইডলাইন ঠিক করা হয়েছিল যেন আগুন লাগলে শ্রমিকদের বাঁচানো যেতে পারে, কিন্তু পরে তা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর পক্ষ থেকে বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এগুলো করতে গেলে খরচ বেড়ে যাবে এবং তা বাস্তবসম্মত নয়। (ডেইলি স্টার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫)।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আহতদের জন্য এবং নিহতদের পরিবারকে সহায়তা দিতে কোটি কোটি টাকা বা ডলার দেশ-বিদেশ থেকে এসেছে। অনেক সংগঠন তা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘটা করে প্রধানমন্ত্রীকে চেক প্রদান করতে দেখা গেছে। কিন্তু এই দুই বছর পরও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এসব শ্রমিক ও তাদের পরিবার কেমন আছে, তাহলে তাদের করুণ চেহারাই বলে দেবে— তারা ভালো নেই। হ্যাঁ, যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা কোনো টাকার অঙ্কে পুষিয়ে দেয়া সম্ভব নয়; কিন্তু তারা যে টাকা পেয়েছেন, সেটাও গ্রহণযোগ্য পরিমাণ নয়। অনেকের চিকিত্সাও এখনো শেষ হয়নি। তারা হাত-পা কাটা অবস্থায় ঘরে কাতরাচ্ছেন। আমরা নিজেরা নানা সময়ে এ শ্রমিকদের কাছে গেছি তাদের বক্তব্য শোনার জন্য এবং প্রত্যেকবারই তাদের কথা শুনে বোঝা গেছে, তাদের কী দুরবস্থা। সিপিডির গবেষণায়ও দেখা যাচ্ছে, যেসব নারী শ্রমিক মাসে কমপক্ষে ১০-১১ হাজার টাকা আয়-রোজগার করতে পারতেন, আজ তারা আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। কোনো কাজ করতে পারছেন না এবং বিল্ডিং ভাঙার ভীতিময় মানসিক পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছেন না। এই শ্রমিক আয় বাড়ানোর জন্য ওভারটাইম, দৈনিক ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজও করেছেন। তেমন একজন শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। এ টাকায় সংসার চালাবেন কী করে? তাকে মাসে অন্তত ৩-৪ হাজার টাকা শুধু ওষুধেই খরচ করতে হয়।
রানা প্লাজার দুই বছর পূর্তিতে এসব কথা কি আলোচিত হবে নাকি শুধু অবস্থার উন্নতি হয়েছে বলে বাহবা নেয়া হবে? আমরা মনে করি, বিদেশী ক্রেতা সংগঠন ও ব্র্যান্ড নিজেদের দায় সারতে চাইছে। এ কাজে আমাদের শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হবে না। আমাদের শ্রমিকদের যথাযথ মর্যাদা এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের মাধ্যমে কাজের পরিবেশ উন্নত করেই এ শিল্প রক্ষা হবে। বিদেশীরা ব্র্যান্ড রক্ষা করবে কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার লাগবে। এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন গার্মেন্ট কারখানার অবস্থার উন্নতি এবং শহরের নাগরিক হিসেবে গার্মেন্ট শ্রমিকের বাসস্থান ও নাগরিক সুবিধার দিক থেকে কী অবদান রাখে তা-ই দেখার অপেক্ষায় আছি।