জিএমও গোল্ডেন রাইসকে না বলুন
ড. এম. এ. সোবহান || Tuesday 01 November 2016 ||প্রথমে রাতকানা রোগ প্রতিরোধের কথা বলে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সে বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠে। অধিকাংশ প্রশ্নের কোন জবাব এখনও পাওয়া যায়নি। গোল্ডেন রাইসও ছাড় হয়নি। তবে তৎপরতা থেমে নেই। এখন আরো নতুন বিষয় যেমন, হাম ও রক্তাল্পতার বিষয়ও তুলে ধরা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের যুক্তি শক্ত করতে।
অন্ধত্ব:
খাদ্যে অনুখাদ্য যেমন, আয়রন, আয়োডিন, জিঙ্ক, এবং ভিটামিন-এ ঘাটতি। বিশেষ করে গরিব মানুষ যাদের খাদ্য চাউল অথবা অন্য শর্করা খাদ্যের উপর বেশী নির্ভরশীল তারাই সাধারণত: অন্ধত্বের শিকার হন।
হাম:
ভাইরাস জনিত শ্বাসযন্ত্রের রোগ। মানুষের নাক ও গলার মধ্যে এর প্রতিলিপি তৈরী হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে এবং দূষিত দ্রব্য স্পর্শের পরে মুখ, নাক অথবা চোখে হাত দিলে হাম রোগ বিস্তার লাভ করে।
রক্তশূন্যতা:
খাদ্যে আয়রণের ঘাটতি, বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের অভাব, খাদ্য নিরাপত্তার অভাব, অন্যান্য ঘাটতি যেমন, ভিটামিন-এ, জিঙ্ক, ফোলেট এবং অন্যান্য অনুখাদ্যের অভাবে রক্তাল্পতা দেখা দেয়।
গোল্ডেন রাইস-২ ইরিতে উদ্ভাবিত হয়েছে (GR2E BRRI dhan 29)
GR2E Kaybonnet Golden Rice এর সাথে- BRRI dhan 29 এর সংকরায়নের মাধ্যমে গোল্ডেন রাইস-২ উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রথমে Kaybonnet ধান জাতের মধ্যে ভুট্টার জিন সংযোজন করা হয়েছিল। (http:// ilsirf.org/wp-content/(uploads/ sites/5/2016/09/Biswa-p.pdf).
স্মরণ যোগ্য ব্রিধান ২৯ যা ১৯৯৪ সালে ছাড় করা হয়। এ জাতটিতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় গ্লাইসেমিক সূচক (৭০ এর বেশী)। যা ডায়াবেটিস প্রবণতা বাড়াতে সহায়তা করে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ১৯৯৫-২০০০ সময় বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের ৪% ডায়াবেটিস আক্রান্ত ছিল। ২০০১-২০০৫ সময় ৫% এবং ২০০৬ -২০১০ সময় ৯% বয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। দিনে দিনে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বাড়ছে। (Bangladesh population and housing census 2011, BBS 2012)।
প্রচলিত ১০টি জাতের ধানের গ্লাইসেমিক সূচক পরিমাপ করে দেখা যায় যে, সেদ্ধ চালের জিআই ব্যাপ্তি ৪৯.৮৭ (বি আর ১৬) থেকে ৭৪.২ (ব্রি ধান ২৯) এবং আতপ চালের জিআই ৫২.৩ (বিআর ১৬) থেকে ৭৬.৩ (ব্রিধান ২৯)। কেবল মাত্র দুটি জাতের ধান (ব্রিধান ১৬ এবং পাজাম) নি¤œ জিআই সম্পন্ন (৫৫ এবং এর নীচে)। (http://www.nfpcsp.org/agridripal/sites/default/files/final-Report-cf-6...).
উচ্চমাত্রায় জিআই সূচক সম্বলিত ব্রিধান ২৯ নির্ভর গোল্ডেন রাইস (GR2E BRRI dhan 29) এর গ্লাইসেমিক ইনডেকস কত হবে? গোল্ডেন রাইস সেবনের ফলে ভোক্তার ডায়াবেটিস প্রবণতা কি আরো বাড়বে? এ সব বিষয়ে কোন তথ্য নাই। তা ছাড়া বাতাস, আলো এবং উচ্চতাপে ভিটামিন-এ কতটা স্থিতিশীল? সেদ্ধ চাল তৈরী করতে ধান একবার সেদ্ধ করা হয়। ভাত রান্না করতে আর একবার চাল ফুটাতে হয়। রান্নার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দিয়ে রান্না করে মাড় ফেলে দেয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন ধাপে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে কি পরিমাণ ভিটামিন-এ ভাতে থাকবে?
বিটাক্যারোটিন কি ভাবে ধানে উৎপাদিত হয় তারও কোন পরিস্কার ব্যাখ্যা এখনে পাওয়া যায় না। তদুপরি জিন কৌশলে উদ্ভাবিত গোল্ডেন রাইস একটি আতঙ্কের নাম। কারণ চাউল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। কৃষকের জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন। ধানের বংশগতির উপর জিন কৌশলের আগ্রাশনের প্রভাবে ধানের পরিবেশ সহনশীলতা, রোগ বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, খাদ্যমান, তথা সার্বিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট পরিবর্তন ঘটাতে পারে, ফলে প্রজাতি হিসাবে ধানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। বাংলাদেশের মত ধান নির্ভর সমাজে গোল্ডেন রাইস এর মত ঝুঁকিপূর্ণ প্রযুক্তি প্রবর্তন এ দেশের মানুষের আত্মহত্যার সামিল হতে পারে। কারণ ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে গোল্ডেন রাইসকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ নামে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেমন গোল্ডেন লাইস (সোনালী মিথ্যা), গোল্ডেন ইলিউশন (সোনালী মায়াজাল) ইত্যাদি।
গোল্ডেন রাইস ভিটামিন-এ ঘাটতি পূরনের একটি ভ্রান্ত প্রযুক্তি। কারন ভিটামিন-এ ঘাটতি মূলত: দারিদ্রের পরিনাম। খাদ্যে বৈচিত্রের অভাব। দারিদ্র জনগোষ্ঠিকে দারিদ্রের জাল থেকে মুক্ত না করে অজানা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়ার কৌশল করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের মত নিবিড় ধান চাষের ভূখন্ডে গোল্ডন রাইসের মত বিকৃত ধান উন্মুক্ত চাষাবাদে ছেড়ে দিলে পরপরাগায়নের মাধ্যমে স্থানীয় এবং প্রচলিত জাতের চারিত্রিক দূষণ ঘটাবে। হাজার হাজার বছর ধরে যে ধান ভিত্তিক জীবন ধারা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা বিপন্ন হবে। কোন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পোকামাকড় ইত্যাদির মারাত্বক আক্রমন ঘটলে তা প্রতিরোধী কোন জাত উদ্ভাবনের জন্য কোন প্রাণ সম্পদ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গোল্ডন রাইসের মধ্যে খাদ্য অথবা পরিবেশ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোন অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন সংগঠিত হলে তা ভবিষ্যতে বড় কোন আশংকা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সে পরিবর্তন পরিমাপ করার মত কোন পদ্ধতি এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। ফলে গোল্ডন রাইস প্রবর্তন করে সর্বক্ষণ অজানা আতঙ্কে থাকতে হবে।
গোল্ডন রাইস যেহেতু বিকৃত প্রযুক্তির ফসল তাই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। কোটি কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত। তবে আগাম কোন খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না।
বিটাক্যারোটিন কিভাবে মানব দেহে রাসায়নিক রূপান্তর ঘটাবে সে বিষয় এখনও পরিস্কার নয়। বর্তমানে যেখানে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের মাধ্যমে ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হয় তার পরিবর্তে অস্পষ্ট ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রশ্ন বিদ্ধ গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের ফলে ব্যাপক জনগোষ্ঠিকে ভিটামিন-এ ঘাটতির ফাঁদে ফেলার কৌশল তৈরি হচ্ছে।
গোল্ডেন রাইস নির্ভর মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার কোন নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নাই। চালের প্রাণ-রাসায়নিক যে কোন অজানা পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। গোল্ডেন রাইসে বিটাক্যারোটিন কিভাবে মানব দেহে কার্যকর হবে এবং অন্য কি রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদিত হবে, সে সব রাসায়নিক মানব দেহে কি কি প্রতিক্রিয়া ঘটাবে, এ সব প্রশ্নের জবাব এখনও অজানা। তদুপরি গোল্ডেন রাইস মানব শিশুর দেহে জন্মগত ক্রটি সৃষ্টি করতে পারে (natural society.com/ miracle-golden-rice-could-cause-birth-defects- warns-indian-scientist/)।
প্রচলিত খাদ্য যেমন-গাজর, লেটুস, হলুদ রং এর মিষ্টি আলু, লাল মরিচ, পাকা আম, পাকা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, পুদিনা শাক, বাঙ্গি, মটরশুটি, শালগম, টমাটো, পালংশাক, সরিষা শাক, ডিম, দুধ, মুরগী, খাসি ও গরুর কলিজা, টুনা মাছ ইত্যাদির মধ্যে ভিটামিন-এ রয়েছে। স্মরণযোগ্য ভিটানি-এ তেল/চর্বিতে দ্রবনীয়। খাবারের সাথে তেল/চর্বি থাকলে ভিটামিন ‘এ’ শরীরে গ্রহণযোগ্য হয়।
গোল্ডেন রাইসকে না বলুন। কারণ এটা আমাদের স্বাস্থ্য, কৃষি এবং প্রাণবৈচিত্র্যের উপর মারাত্বক হুমকি। বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও জিএম ধানের আবাদ হয় না। ১৯১১ সালে চীন এবং থ্যাইল্যান্ডে জিএম ধানের পরীক্ষা মূলক আবাদ বন্ধ করা হয়েছে (www.cban.ca/Resources/ Topics/GE-crops-and-Foods-no-on-the-Market/Rice)
গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের মাধ্যমে জিন বিকৃতির জটিল জালে আবদ্ধ না হয়ে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জৈব কৃষি চর্চা করে ভিটামিন‘এ’ ঘাটতি পূরণসহ নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে।