ডায়াবেটিস: সামলাতে বিভিন্ন জাতের ধান
ড. এম. এ সোবহান || Saturday 09 April 2016 ||ডায়াবেটিস একটি ব্যাধি যা শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন না থাকা বা অগ্নাশয়ে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন না হওয়ার জন্য সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা। ইনসুলিন একটি হরমোন যা রক্তের মধ্যে বিদ্যমান গ্লোকোজ শুষে নেয় এবং শরীরে শক্তি জোগায়। মানুষ যখন খাবার খায় তখন অগ্নাশয় প্রাপ্ত গ্লোকোজ শুষে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিন উৎপাদন করে। তবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের শরীরে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন থাকে না অথবা উৎপাদিত হয় না। অথবা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় তা শরীর গ্রহণ করে না। ফলে রক্তের মধ্যে গ্লোকোজ জমা হয় এবং প্রস্রাবের সাথে শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়। ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব দেখা দেয়।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের প্রার্দুভাব:
২০১৫ সালে এ দেশে ৭১ লক্ষ ডায়াবেটিস রোগী ছিল। দিনে দিনে যে হারে ডায়াবেটিস বাড়ছে তাতে আশঙ্কা হচ্ছে ২০২০ সালে এ সংখ্যা এক কোটি ষাট লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
ডায়াবেটিসের কারণ:
নানা কারণে ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে অধিক মানষিক চাপ, অস্বাভাবিক ভাবে মোটা হয়ে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত শারীরিক অনুশীলনের সুযোগের অভাব। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে শরীরে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাবার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপাত দৃষ্টিতে উচ্চফলনশীল জাতের ধান বিস্তারের পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বাড়ছে। তবে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের ডায়াবেটিস রোগও বেড়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে ২০০৮ সালে ধান উৎপাদনের জমির মধ্যে ২৯% জমিতে দুটি উচ্চফলনশীল ধানের (ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯) জাত আবাদ হয়েছে। এ দুটি জাতের মধ্যে উচ্চ মাত্রায় গ্লাইসেমিক সূচক রয়েছে। পক্ষান্তরে যে ধান জাতের মধ্যে নিম্ন মাত্রার গ্লাইসেমিক সূচক বিদ্যমান তার আবাদ হয়েছিল মাত্র ৪% জমিতে। বাংলাদেশে বৎসরে তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টন ধান উৎপাদন হয় যার মধ্যে ৫৬% রয়েছে উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত দুটি ধানের জাত যেমন, ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯।
গ্লাইসেমিক সূচক:
গ্লাইসেমিক একটি সংখ্যা সূচক যা রক্তে গ্লোকোজের পরিমাণ নির্দেশ করে। খাদ্যে গ্লোকোজের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে গ্লাইসেমিক সূচকের শ্রেণী করণ করা হয়। গ্লাইসেমিক সূচক তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় যেমন: উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৭০+) যে খাদ্য রক্তে গ্লোকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। মধ্যম গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৬-৬৯)। নিম্ন গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৫ বা তারও কম), যা ধীর গতিতে রক্তে গ্লোকোজ সরবরাহ করে।
উচ্চ গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৭০+):
কর্নফ্লেক্স, মুড়ি, সাদা চাল, নুডলস, পনির, মিষ্টি কুমড়া, গোল আলু, পপকর্ন, আনারস, বাতাবিলেবু, ইত্যাদি।
মধ্যম গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৬-৬৯):
তরল পানীয়, মিষ্টি ভুট্টা, কিসমিস, পাকা কলা, মধু, বাসমতি চাল ইত্যাদি।
নিম্ন গ্লাইসেমিক যুক্ত খাদ্য (জি আই ৫৫ বা তারও কম)
গম, যব, লাল চাল, মেটে আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, শিম, চীনাবাদাম, গাজর, ডাল, প্রায় সব ধরনের ফল, শাক সবজি। ফলের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য আপেল, কমলা লেবু, টমেটো, খেজুর, আঙ্গুর, ইত্যাদি।
যে কারণে গ্লাইসেমিক সূচক পরিবর্তন হয়:
আঁশ যুক্ত খাদ্য গ্লাইসেমিক সূচক কমাতে সহায়তা করে। সাধারণভাবে বেশী রান্না করা বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে গ্লাইসেমিক সূচক বেড়ে যায়। একই ভাবে বেশী পাকা ফল বা সবজিতেও উচ্চ মাত্রায় গ্লাইসেমিক সূচক থাকে। আলু ভর্তায় আস্ত পোড়া আলুর চেয়ে উচ্চহারে গ্লাইসেমিক সূচক থাকে। সাদা চালে লাল চালের চেয়ে বেশী গ্লাইসেমিক সূচক থাকে।
ধানে গ্লাইসেমিক সূচক
ধানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে গ্লাইসেমিক সূচকে’ র ব্যাপ্তি রয়েছে। নীচের ছকে বাংলাদেশের কয়েকটি ধান জাতের গ্লাইসেমিক সূচক প্রদান করা হ’ল।
ছক ১: নির্বাচিত কয়েকটি ধান জাতের গ্লাইসেমিক সূচক
৩
ক্রমিক | ধানের জাত | গ্লাইসেমিক সূচক | |
সেদ্ধ | আতপ | ||
১ | বি আর ১ | ৫৪.৭ | ৬২.৪ |
২ | বি আর ১১ | ৬১.৫ | ৬৪.৮ |
৩ | বি আর ১৬ | ৪৯.৮ | ৫২.৩ |
৪ | বি আর ২৬ | ৬৮.৫ | ৭১.৪ |
৫ | ব্রিধান ২৮ | ৬৫.৯ | ৭০.৫ |
৬ | ব্রিধান ২৯ | ৭৪.২ | ৭৬.৩ |
৭ | ব্রিধান ৩০ | ৫৯.৬ | ৬২.৪ |
৮ | ব্রিধান ৪০ | ৫৬.২ | ৫৯.৫ |
৯ | পাজাম | ৫৪.২ | ৫৮.৬ |
১০ | চিনি গুড়া | - | ৭০.২ |
উপরের ছক থেকে দেখা যায় যে সেদ্ধ চালের গ্লাইসেমিক সূচক ৪৯.৮- ৭৪.২ এবং আতপ বা (অসেদ্ধ) চালের গ্লাইসেমিক সূচক ৫২.৩- ৭৬.৩। মাত্র দুটি জাত (বি আর ১৬ এবং পাজাম) এর গ্লাইসেমিক সূচক নিম্ন মাত্রার (৫৫ এবং এর নীচে)। অধিকাংশ জাতগুলি মধ্যম মাত্রার গ্লাইসেমিক সূচকের মধ্যে (৫৬-৬৯) রয়েছে। তবে ব্রি ধান ২৯, চিনি গুড়া, বি আর ২৬ এবং ব্রি ধান ২৮ জাতগুলি উচ্চমাত্রার গ্লাইসেমিক গোত্রভুক্ত।
উপসংহার:
মানব দেহে গ্লোকোজের মাত্রা অনেক কারণে কম বা বেশী হতে পারে। গ্লোকোজের মাত্রার প্রতি সচেতন দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন। যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে গ্লোকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলে হার্ট এটাক, কিডনি বিকল হওয়া অথবা অন্ধত্বের মত অভিশাপ থেকে মুক্ত থেকে সুস্থ জীবন যাপন করা যায়।
দেশে প্রচলিত ধানের জাতগুলির গ্লাইসোমিক সূচক মূল্যায়ন করে কম গ্লাইসোমিক সূচকযুক্ত জাতগুলিন আবাদ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।