হারিয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবন
রফিকুল হক টিটো || Thursday 17 December 2015 ||স্থানীয়ভাবে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন বা প্যারাবন নামে পরিচিত এবং এই বনভূমি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এই ম্যানগ্রোভ এলাকা জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে অভ্যন্তরীণ ভূমি ও জনপদকে রক্ষা করে।
সুন্দরবন বলতে আমরা বুঝি জাতীয় সুন্দরবন, যা খুলনায় অবস্থিত। দেশে যে আরও একটি সুন্দরবন ছিল, তা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ কিংবা পরিবেশবাদী ও সচেতন কিছু লোক ছাড়া অনেকেই জানেন না। কক্সবাজারের চকরিয়ায় ছিল এই সুন্দরবন। এবং তা আজ কালের আবর্তে লোকজনের মনের আড়াল হতে চলেছে।
কক্সবাজারের উপকূলবাসীকে গ্রীন হাউজ এফেক্ট থেকে রক্ষা করতে চকরিয়া সুন্দরবনের যে কী অপরিসীম গুরুত্ব ছিল তা এতদাঞ্চলের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করছে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে উক্তি “ না পাওয়ার চাইতে পেয়ে হারানোর বেদনা” কী কঠিন, এতদাঞ্চলের বান আদমরা চকরিয়া সুন্দরবনকে নিয়ে চিন্তা করলেই এর ভাবার্থ খুঁজে পায়।
এ লেখা যখন লিখছি তখন চকরিয়া সুন্দরবন পুস্তকে-কলমে সীমাবদ্ধ। প্যারাবনের বিরল প্রজাতির গাছপালা, পশুপাখি ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার- এসব গল্পের মতো মনে হবে অনেকের।
চকরিয়ার উপকূলীয় এলাকায় গড়ে উঠা ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে অসংখ্য সুন্দরী গাছ থাকায় এর নাম হয় চকরিয়া সুন্দরবন। এ উপমহাদেশে যে ক’টি ম্যানগ্রোভ টাইটাল ফরেস্ট রয়েছে চকরিয়া সুন্দরবন ছিল তার অন্যতম। গবেষণায় জানা যায়, প্রাথমিকভাবে চকরিয়া সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৪৫ হাজার ৫শত একর। পরবর্তীতে সরকার সুন্দরবনের বেশ কিছু ভূমি বন্দোবস্তি দেয়ায় চকরিয়া সুন্দরবনের আয়তন দাঁড়ায় ২১ হাজার একর।
চকরিয়া সুন্দরবনের চারদিক জলরাশি পরিবেষ্টিত। পূর্বদিকে আরকান সড়ক, উত্তর-পূর্ব দিকে জনবসতি, কৃষিভূমি, লবণ মাঠ, সোজা দক্ষিণ দিকে মহেশখালী চ্যানেল, মাতামুহুরী নদীর পশ্চিম পাশের সুন্দরবন রামপুর এলাকা নামে পরিচিত আর পূর্ব পাশে চরণ-দ্বীপ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর মতে, এককালে চকরিয়া সুন্দরবন এলাকা ছিল অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও ওষুধি বৃক্ষে ভরপুর। সুন্দরী কাঠ, গেওয়া, গরান, কেওড়া, ধুন্দল, গোলপাতা সংগ্রহের জন্য চকরিয়া সুন্দরবন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়া হরিণ, বানর, হনুমান, বনবিড়াল, কুমির, অজগর, গুইসাপ সহ অসংখ্য রকমের প্রাণীর বাস ছিল সুন্দরবনে।
প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত প্যারাবন উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করতো মাটির ক্ষয় ও ভাঙ্গন থেকে। সমুদ্রের জোয়ারের তোড় থেকে উপকুলীয় বেড়িবাঁধ রক্ষা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে এবং গ্রীণ হাউজ এ্যাফেক্ট থেকে উপকূলবাসীকে নিরাপদে রাখতো। কিন্তু এখন আর সে দৃশ্য চোখে পড়ে না। চকরিয়া সুন্দরবনকে চিংড়ি চাষের জমিতে রুপান্তরিত করায় উপকূলীয় এলাকার পরিবেশের উপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চিংড়ি চাষ করার ফলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ধংস হয়ে গেছে। যার কারণে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হতে হয় উপকুলীয় এলাকার মানুষকে।
চিংড়ি চাষের ফলে উপকূলীয় এলাকার পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তা হলো অনাবৃষ্টি, জ্বালানী সংকট, গো-মহিষের খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি, ধান উৎপাদন হ্রাস, গরীব মানুষের জীবিকার উৎস বন্ধ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতি বৃদ্ধি, শাক-সবজি উৎপাদন হ্রাস, প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি সাধন, পোনা আহরণের সময় নির্বিচারে মৎস্য নিধন করায় মৎস্য সঙ্কট, সর্বোপরি চিংড়ি চাষ হওয়ায় রামপুর, চরণদ্বীপ এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি বছর চিংড়ি মৌসুমে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ, দখল-বেদখল বিষিয়ে তুলছে চকরিয়া সুন্দরবন লাগোয়া মানুষগুলির নিত্যদিনকার জীবনযাত্রা। যেখানে এক সময় ঐ মানুষগুলো চকরিয়া সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল হয়ে তাদের জীবন-জীবিকা চালাতো তারা আজ অনেকে বেকার। গরীব মানুষগুলো যারা সুন্দরবনের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিল তারা আজ বিপন্ন।
পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, প্যারাবন নিধন ও নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধ্বংস করে চিংড়ি চাষ করায় প্রাথমিক ভাবে স্বল্প সময়ের জন্য এ এলাকার মানুষগুলো অর্থবান হলেও প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর জনগোষ্টি পড়ছে ক্ষতির কবলে। এখনো উপকুলীয় এলাকার বেড়ি বাঁধগুলো হুমকির সম্মুখীন, আতঙ্কিত বেড়িবাঁধ লাগোয়া মানুষ।
বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি করে এ এলাকার কিছু মানুষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হলেও চকরিয়া সুন্দরবন বিলুপ্ত হওয়ার পর দেশের কী যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখছে না। নানা সভা সেমিনারে এ অভিমত ব্যক্ত করে পরিবেশ রক্ষার জোর দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। আজ সকলের সমন্বিত দাবি, প্রাকৃতিকভাবে সৃজিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নির্বিচারে যেভাবে নিধন করা হয়েছে তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে খালী জায়গায় সৃজন করতে হবে প্যারাবন। রক্ষা করতে হবে আগামি প্রজন্মকে।
এ দাবি এ সময়ের উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি। “ভিক্ষা চাই না মা, কুত্তা সামলাও”। বৈদেশিক মুদ্রা চাই না, চাই নিরাপদে বসবাস করার সুনিবিড় স্থান।
উবিনীগ কর্তৃক প্যারাবন সৃজন
১৯২৮ সালের পূর্বে বদরখালী এবং আশ-পাশ এলাকা প্রায় ৫০০০ একর গভীর ম্যানগ্রোভ বন ছিল। বৃটিশ সরকার ১৯২৯ সালে ভূমিহীনদের নিয়ে বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি গঠন করে এবং ৪০০০ একর গভীর ম্যানগ্রোভ বন কেটে সমিতির সভ্যদের পুনর্বাসন করেন। তারপর থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৭০ বছরের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ম্যানগ্রোভ বনায়নের কথা চিন্তা করেনি।
উবিনীগ নয়াকৃষি আন্দোলন ১৯৯১ সনের প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড়ের পর বদরখালী ইউনিয়নে স্থানীয় সরকার, বদরখালী সমবায় কৃষি উপনিবেশ সমিতি ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বদরখালী এলাকার পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলের পূর্ব প্রান্তে ৭ কি:মি এলাকায় কেওড়া (Sonneratia apetala) ও বাইন (Avcennia officinalis) প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বনায়ন করে।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালের বদরখালী ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণ প্রান্তে মাতামুহুরী নদীর উত্তর দিকে উবিনীগ কেন্দ্রের সামনে প্রায় ৫০ একর জায়গায় চারা রোপন করে। (যদিও এগুলো আর অবশিষ্ট নেই) পুরো এলাকায় বনায়নের পর সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে রোপনকৃত চারাগুলো বড় গাছে রূপান্তরিত হয়।
উবিনীগ কর্তৃক ১ম ও ২য় ধাপে যথাক্রমে ১৯৯২ সনে ৭ কি:মি: চর এবং ১৯৯৭ সনে প্রায় ৫০ একর জায়গায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন করার পর গত ১৭ বছরে নতুন করে বিভিন্ন সময়ে জেগে উঠা চরে নতুন করে রিং বাধ দিয়ে বদরখালী সমিতি উক্ত জায়গা দখল করে চিংড়ি ঘের নির্মান করে। ফলে ১৯৯২ সনে রোপন কৃত ৭ কি:মি: জায়গায় গাছের শতকরা ৪০ ভাগ গাছ কেটে ফেলা হয় এবং ১৯৯৭ সালের রোপন করা প্রায় ৫০ একর জায়গায় পুরো বনটাই নিধন করা হয়। রিং বাধের উপরিভাগে চিংড়ি ঘের নির্মিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটায় পানি ঘেরে ঢোকানো এবং বের করার জন্য স্লুইচ গেট তৈরী করা হয়। ভাটার সময় স্লুইচ গেটের মাধ্যমে পানি নেমে আসার কারণে অনেক জায়াগায় বড় বড় গর্ত ও নালার সৃষ্টি হয় সে জায়গা গুলোতে গাছ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সমিতি কর্তৃক রিং বাধ নির্মান করার পরেও বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় উবিনীগ কর্তৃক চারা রোপনের কাজ অব্যাহত ছিল।
অপর দিকে গত ১৫/১৬ বছরে ব্যবধানে চরের গঠন পরিবর্তন হয় এবং নতুন করে চর জেগে উঠায় বনায়নের সম্ভবনা তৈরী হয়। তারই প্রেক্ষিতে জেগে উঠা চরে ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত আরও ৫ কিলোমিটার এলাকায় ২ লক্ষ কেওড়া ও বাইন প্রজাতির চারা রোপন করা হয়।
২০১১-২০১২ সালে উবিনীগ মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নে মহেশখালী চ্যানেলের পশ্চিম প্রান্তে অর্থাৎ জেএম ঘা থেকে দক্ষিণ দিকে হিন্দু পাড়া পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় বাইন ও কেওড়া প্রজাতির চারা রোপন করে। বর্তমানে চারাগুলো ৮-১০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৯৯২ সাল থেকে রোপন করা গাছ এখন বড় বড় বৃক্ষরাজিতে পরিণত হয়েছে।