লিলি আপা ও নবপ্রাণ
উবিনীগ || Friday 20 September 2019 ||আমাদের কাজের মধ্যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এমন একটি কাজ হচ্ছে নবপ্রাণ আন্দোলন। সংগঠন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল একদমই অদ্ভূত। একদিকে কর্পোরেট স্ট্রাকচার আমরা পরিহার করেছি শুরু থেকেই, অন্যদিকে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া শৃংখলা ও বিধিবিধানের নাগপাশে আমরা বন্দী থাকতে চাই নি। শুরু থেকেই ঠিক করেছিলাম খুব ভোরে এবং সন্ধ্যায় গান গাওয়ার মধ্যে আমরা এমন একটা সাংগঠনিক বন্ধন তৈরি করব যেন কাজ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তার জন্য কোন পুলিশি বা নজরদারি লাগে না।
উবিনীগে সকাল ও বিকাল গান গাওয়ার রেওয়াজ দ্রুতই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। সকালে গোষ্ঠ গান, বিকেলে দৈন্য গান। নিদেন পক্ষে বিকেলে তিনটি দৈন্যগান গাইবার পর যার যা ভাল লাগে গাইত। উর্দু, নেপালি, হিন্দি যে কোন ভাষায়। তার মধ্যে ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল...’ থেকে শুরু করে ‘তু যাঁহা কাঁহি ভি যায়ে মেরা পেয়ার ইয়াদ রাখ না’...’। এক দারুন সংগঠন গড়ে তুলি আমরা যেখানে কাজ আর ব্যাক্তিগত সময়ের মধ্যে ফারাক নির্ণয় করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে গান গাওয়া খুব সংগঠিত ভাবে গড়ে উঠেছিল ১৯৯৪ সালে নবপ্রাণ আন্দোলন গড়ে ওঠার পর। আমরা বুঝে ছিলাম নয়াকৃষি আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার সাধকদের ধারার একটা যোগ ঘটিয়ে না দিলে ইকোলজি, এনভায়রনমেন্ট, প্রকৃতি রক্ষা ইত্যাদি পশ্চিমা বাগাড়ন্বর হবে। আমাদের দরকার ছিল বাংলার ভাবান্দোলন বা ভাবচর্চার সঙ্গে অন্তরের সম্বন্ধ, এম এক সম্বন্ধ যেখানে কৃষি এবং প্রাণের সুরক্ষা আমাদের চিত্তের স্ফূর্তির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। নবপ্রাণ আন্দোলন সেটা ঘটিয়ে দিল। নবপ্রাণ শুধু গান গাওয়া এবং অনুষ্ঠান করার জন্যে হয় নি, হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন সাধক ধারার স্বাতন্ত্র্য চেনা এবং বৈশিষ্ট্যের মর্ম বোঝা; তার সঙ্গে নাভির গিঁট বেঁধে ফেলা কর্তব্য বুঝে গিয়াছিলাম আমরা সহজেই। বাংলাদেশে আমাদের প্রাণের গান, যাকে নিছক পল্লীগীতি বলে উল্লেখ করা হয়, সেই গান খুঁজে বের করা এবং চর্চা করার সঠিক ক্ষেত্র দরকার। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল ফকির লালন সাঁইয়ের গানের সুর, বাণী ও ভাবের অন্দর মহলে প্রবেশের তাগিদ। সেই ভাব বজায় রেখে গাওয়ার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা আমরা করছি। কবি ফরহাদ মজহার এই ধারণা যখন প্রথম নিয়ে এলেন তখন প্রশ্ন ছিল এ কাজ করার জন্যে নেতৃত্ব দেবে কে? এর অনেক ব্যবহারিক দিক আছে। এই সময় এগিয়ে এলেন আমাদের সবার লিলি আপা। ফেরদৌস আখতার লিলি। তিনি পেশায় শিক্ষকতা করতেন কিন্তু এর বাইরে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে আরও বেশি জড়িত থাকতেন। তিনি নবপ্রাণ আন্দোলন গড়বার দায় সানন্দে কাঁধে তুলে নিলেন।
আমাদেরও সৌভাগ্য যে লিলি আপা নবপ্রাণের দায়িত্ব নিলেন এবং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর সাথে আয়শা আখতার, ফরিদা আখতার, আমির হোসেন খান, রোকেয়া বেগম, আব্দুল কুদ্দুস, আরিফুল হক, সুকুমার চন্দ্র দাস, বজলুর রহমানসহ অনেকে জড়িত হলেন। প্রবর্তনায় একের পর এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হোল। লিলি আপা একটা খাতা রাখতেন। কোন অনুষ্ঠানে কি গান হবে, কোন গানের সাথে কোন যন্ত্র বাজবে, কে কোন গান গাইবে, কার গানের জন্যে কি রকম রিহার্সেল করতে হবে, ইত্যাদি কোন খুঁটিনাটি বিষয় বাদ পড়ত না। কোরাস গান থাকতেই হবে। এবং সে গানগুলো কিভাবে করলে সবার কন্ঠের সম্বন্বয় ঠিক হবে, তার জন্যে মাইক কোনটা কোনদিকে বসবে তাও হিশাব করা হোত। পোষাক নিয়ে ভাবলেও অতি সাজগোজ মার্কা অনুষ্ঠান নবপ্রাণে কখনই হোত না। বলতেন আমরা গানের মান দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করবো, সাজগোজ দিয়ে নয়। এভাবে বিভিন্ন সাধকদের গানের অনুষ্ঠান, ফকির লালন সাঁইয়ের গানের অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল নবপ্রাণের শনিবারের গানের আসরে। অনেকই আসতেন গান গাওয়ার জন্যে, এসে খোঁজ করতেন লিলি আপাকে। তিনি তাদের সময় দিতেন, গানের অনুষ্ঠানের তারিখ ঠিক করে দিতেন। তাঁর মোবাইল ফোনে ভরে থাকতো জানা-অজানা অনেক শিল্পী এবং শিল্প গোষ্ঠির ফোন নম্বরে। সারাক্ষণ ফোন বেজেই চলেছে। শিল্পীরা একটি অনুষ্ঠানের সুযোগ পেয়ে খুশি হতেন। রীতিমতো অনুরোধের লাইন পড়ে যেতো। তবে যে কেউ যে কোন গান গাইলেই হবে না। নবপ্রাণের যে নীতি রয়েছে তার আলোকেই হতে হবে। এই সব হিশাব-নিকাশ লিলি আপাই করতেন।
লিলি আপা নিজেও গান করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একক গান এবং কোরাসে কন্ঠ দিতেন। কিন্তু নবপ্রাণের শিল্পীদের অনুষ্ঠানের দিনে তিনি নার্ভাস থাকতেন একটু বেশি মাত্রায়। সব শিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্রীরা ঠিক মতো আসবে তো, সবার গান ঠিক মতো এবং ভাল হবে তো? তাদের গান ভাল হলে যতো খুশি হতেন, নিজের গানের বেলায় সেরকম ভাব রাখতেন না। ভাল হলে হবে। যদিও নিজের বাছাই করা গানটি ঠিকভাবে গাওয়ার জন্যে যথাসাধ্য চর্চা করতেন। বলা বাহুল্য তাঁর গানও খুব ভাল হোত।
একসময় নবপ্রাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হোল, ক্লাসিকাল গান শেখার এবং এর চর্চা করার। নবপ্রাণ সংগীত ঘর প্রতিষ্ঠিত করা হোল। যুক্ত হলেন ক্লাসিকাল গানের শিক্ষক আকরাম হোসেন বাবলা। এই সঙ্গীত ঘর ঠিকমতো চালাবার জন্যে লিলি আপা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। সঙ্গে ছিলেন রুবিনা আকরাম। অনেকেই গান শিখতে আসলেন, একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।
গানের বই, স্বরলিপির বই কেনা, নিজের হাতে গানগুলো লিখে ফেলার কষ্টসাধ্য কাজগুলো বসে বসে করতেন। এভাবে অনেক নোটখাতা তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে দেখে সেই অনুষ্ঠানের ভাল মন্দ নিয়ে কথা বলতেন। যে কোন অনুষ্ঠানের পর মূল্যায়ন করতেন কঠোরভাবে। যার যেখানে ত্রুটি সেটা ধরিয়ে দিয়ে শোধরানোর পরিকল্পনা করতেন।
যিনি নবপ্রাণ গড়েছিলেন সেই লিলি আপা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তারিখে বিকেল ৫.৩০ মি। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার কারণে নবপ্রাণের কাজ তিনি আর সামলাতে পারতেন না। শেষের দিকে যুক্ত থাকা সম্ভব হয় নি। তাঁকে এতো ওষুধ খেতে হোত যে শরীর ক্লান্ত হয়ে যেতো। তবুও নবপ্রাণের জন্যে তাঁর আকুতিটুকু সবসময় থাকতো। এর মধ্যে ২০১০ সালে আয়শা আখতার হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই স্ট্রোক করে মারা যাওয়ায় ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। য়ায়শা একাধারে হারমোনিয়াম বাজানো, নিজে গান গাওয়া এবং অন্যদের শেখানো সব কাজ করতেন। বলতেন আয়শা আমাদের একেবারে কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে। তবুও চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন যথা সাধ্য।
এখন নবপ্রাণের মূল অনুষ্ঠান হয় কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে বছরে দু’বার; ফাল্গুন পুর্ণিমায় লালন উৎসব এবং পয়লা কার্তিকে লালনের তিরোধান দিবস পালন। ছেউড়িয়াতে লিলি আপা গেছেন কয়েকটি অনুষ্ঠানে, পরের দিকে আর যেতে পারেন নি।
নবপ্রাণে তিনি যে বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছেন তা ধীরে ধীরে বেড়েছে। বাড়বে। লিলি আপা নাই। আমরা কেউই চিরকাল থাকব না। কিন্তু বাংলার ভাবুক ও সাধকদের সাধনার ক্ষেত্রটিকে ঢাকা শহরের বিদগ্ধ জনদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ফেরদৌস আখতার লিলি যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।