জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২: ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন
ফরিদা আখতার || Monday 08 August 2022 ||সাধারণত জনশুমারির গণনার কাজ মার্চ মাসে হয়; ২০১১ সালে জনশুমারি হয়েছিল ১৫ থেকে ১৯ মার্চ। এই সময় শুকনো মৌসুম, কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। এবারের জনশুমারির কাজ একেবারেই উপযোগী সময়ে হয়নি, এমনকি দেশের বেশ কয়েকটি জেলা সে সময় বন্যায় ডুবে ছিল। মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। এই সময় ঘরে ঘরে গিয়ে লোক গণনা করা প্রায় অসম্ভব বলা যায়। তাহলে এই তথ্য নেয়া হলো কী করে? ডিজিটাল শুমারি মানে এই নয় যে ঘরে ঘরে যেতে হবে না।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার এবং মোট খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ, সর্বশেষ 'জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২'-এর প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে এতদিন যারা ১৭ কোটি, ১৮ কোটি মানুষ এই করেছে, সেই করেছে বলে মুখে ফেনা তুলেছেন তাদের একটু থেমে বলতে হবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির একটু বেশি।
প্রায় ১১ বছর পর জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম ১৫ জুন থেকে একযোগে শুরু হয়ে ২৮ জুন পর্যন্ত চলেছে। বন্যার কারণে কিছু জেলায় গণনা করতে সপ্তাহ খানেক দেরি হয়েছিল। ঢাকাতেও অনেকে অভিযোগ করেছেন তাদের বাড়িতে কেউ গণনার জন্যে আসেনি, অর্থাৎ গণনার বাইরেও অনেক মানুষ রয়ে গেছে। সাধারণত জনশুমারির গণনার কাজ মার্চ মাসে হয়; ২০১১ সালে জনশুমারি হয়েছিল ১৫ থেকে ১৯ মার্চ। এই সময় শুকনো মৌসুম, কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। এবারের জনশুমারির কাজ একেবারেই উপযোগী সময়ে হয়নি, এমনকি দেশের বেশ কয়েকটি জেলা সে সময় বন্যায় ডুবে ছিল। মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। এই সময় ঘরে ঘরে গিয়ে লোক গণনা করা প্রায় অসম্ভব বলা যায়। তাহলে এই তথ্য নেয়া হলো কী করে? ডিজিটাল শুমারি মানে এই নয় যে ঘরে ঘরে যেতে হবে না।
তাই এই প্রাথমিক ফলাফল ত্রুটিমুক্ত নয়, নানান দিক থাকে প্রশ্নবিদ্ধ। ডিজিটাল পদ্ধতিতে করলেও অনেক প্রশ্ন উঠছে। তবে পূর্বের সব জনশুমারির প্রাথমিক ফলাফল আর চূড়ান্ত ফলাফলে কিছু হেরফের সব সময় হয়েছে। চূড়ান্ত ফলাফলে বদলে গেছে মোট জনসংখ্যার সংখ্যা, এমন নজিরও আছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে শুমারি-পরবর্তী যাচাই (পিইসি) জাতিসংঘের নির্দেশিত নীতিমালা অনুযায়ী নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র ব্যক্তির মাধ্যমে করা হবে। এবং সেখানে প্রাথমিক ফলাফল সমন্বয় করা হবে; সেই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাই প্রাথমিক ফলাফল দিয়ে বিশ্লেষণের সুযোগ কম।
২০১১ সালে জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৬৯৭। দশ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। তবে এবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২%; আগের তুলনায় কমেছে, ২০১১ সালে ছিল ১.৮৬%।
জনশুমারি রাষ্ট্রগুলো নিজ দায়িত্বে করলেও জাতি সংঘের Worldometer-এর গণনাও আছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লক্ষ ৭২ হাজার ১৬৫। আমাদের জনশুমারির ফলাফলের চেয়ে বেশি। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ করে না, কিন্তু তাদের হিসাবনিকাশের ফর্মুলা আছে। তাদের হিসাবে বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭.৯৬ বিলিয়ন (৭৯৬ কোটি), বাংলাদেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২.১১% শতাংশ বাস করছে, এবং জনসংখ্যার দিক থেকে অস্টম স্থানে আছে। এ ছাড়াও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএরও গণনা থাকে ।
পত্রপত্রিকায় এবারের জনশুমারির একটি তথ্য খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। বলা যায় বড় শিরোনাম করেছে। তা হচ্ছে, নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। অথবা পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে কম। পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন।
মাত্র ১৬ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩৮২ জন নারী পুরুষের তুলনায় বেশি হয়েছে তাতেই বেশ হইচই পড়ে গেছে। প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে ৯৮ জন পুরুষ, যা এর আগে আর কখনো হয়নি। কিন্তু একই দিনে (২৭ জুলাই) countrymeters-এ দেখাচ্ছে ৮ কোটি ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৪৯২ জন পুরুষ এবং ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৩২ জন নারী। পুরুষ ৫০.৬%, নারী ৪৯.৪%। অর্থাৎ নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। এই সংখ্যাও কি সমন্বয় হবে? এখানে একটা বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা কত, তার হিসাব কেবল পরিসংখ্যান ব্যুরো একাই করে না, বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও করে। তার মধ্যে World Data Atlas অন্যতম, যা জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) দ্বারা অনুমোদিত। এই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২০২০ সালেও বাংলাদেশে পুরুষ-নারী অনুপাত ছিল ১০২.২৫ জন পুরুষের বিপরীতে ১০০ নারী। এই অনুপাত বিভিন্ন বয়সে পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে বদলায়। যেমন ০ থেকে ২৪ বছর বয়সের পুরুষ-নারীর অনুপাত ১০৪.২৫: ১০০; ২৫ থেকে ৬৯ বছর বয়সের পুরুষ-নারীর অনুপাত ১০০.৯১: ১০০; আর ৭০ বছরের বেশি বয়সি পুরুষ-নারীর অনুপাত ৯৬.৩১: ১০০। এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়, বেশি বয়সে এসে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি বাঁচে! হায় নারী। তার যখন বেঁচে থাকা দরকার সে বয়সে সে ঝরে যাচ্ছে। যারা বেঁচে থাকছে তারা বিধবার জীবন কাটাচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে; উচ্চবিত্ত হলে বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েদের গুলশানের বাড়ি পাহাড়া দিচ্ছেন। অথচ শূন্য থেকে ২৪ বছরের নারী কেন পুরুষের তুলনায় কম তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
এই জনশুমারিতে (২০২২) বয়সভেদে পুরুষ-নারী অনুপাত দেখানো হয়নি। শুধু মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি দেখে মিডিয়া খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বয়সভেদে পুরুষ-নারীর অনুপাত জানা না যাবে ততক্ষণ এই বিষয় কথা বলা ঠিক হবে না। কয়েক লাখ নারী সংখ্যায় বেশি হয়েছে বলে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে এমন তো নয়। নারীদের স্বাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় কম। জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী পুরুষ জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার ৭৬.৫৬%, নারী জনগোষ্ঠীর এ হার ৭২.৮২%।
প্রাথমিক ফলাফলে আরও জানা গেছে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী আছে মাত্র ১২ হাজার ৬২৯ জন। এই সংখ্যা সঠিক কি না সেটাও দেখা দরকার। এখানেও তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে।
ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে ২০২২ সালের জনশুমারিতে মোট জনংখ্যার ৯১.০৪% মুসলমান, হিন্দু ৭.৯৫%, বৌদ্ধ ০.৬১%, খ্রিস্টান ০.৩০%। মুসলমান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আগের জনশুমারির তুলনায় বেড়েছে, কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে। এই বিষয়টিও খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ০.৬৫%। খুব বেশি বাড়েনি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমে যাওয়ার হারও খুব বেশি নয়। যেমন হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে ০.৫৯%, বৌদ্ধ্ কমেছে ০.০১%, খ্রিস্টান কমেছে ০.০১%। এটা জনমিতির একটি বিষয় হতে পারে, কিন্তু অন্য কারণ কী হতে পারে, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তবে সার্বিকভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে গেছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন।
মোট জনসংখ্যার ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জন, অর্থাৎ ১.৪৩%-এর কমপক্ষে এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ প্রতিবন্ধী ১.৬৩ % এবং নারীর প্রতিবন্ধী ১.২৩%। এই পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের জনশুমারিতে দেখা গেছে প্রতিবন্ধিতার হার ১.৪% ছিল। এটা ২০২২ সালে ০.০৩% বেড়েছে, কিন্তু ২০১১ সালে বিবিএস-এর করা Household Income Expenditure Survey-তে জনসংখ্যার ৯.০৭% প্রতিবন্ধী বলে দেখানো হয়েছে। জনশুমারির গণনায় এত কম প্রতিবন্ধী থাকাটা স্বাভাবিক নয়।
জনশুমারির প্রধান আকর্ষণ থাকে তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে। জনশুমারি অনুযায়ী ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১; যা মোট জনসংখ্যার ১৯.১১%। আগের শুমারিতে ছিল ১৮.১৬% অর্থাৎ কিছুটা বেড়েছে। তার চেয়েও বেশি হচ্ছে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা, ২৮.৬১%। আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা একেবারে কম , মাত্র ৫.৮৮%। যা অন্যান্য দেশে অনেক বেশি এবং এটাকে সমস্যা হিসেবেই দেখা হয়।
তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি আছে বলে জনমিতির দিক থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। কারণ ১৫ থেকে ২৪ বছরের ছেলেমেয়েরাই তো পোশাক কারখানায় কাজ করে আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করে, বিদেশে পাড়ি জমায় আর দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। কিন্তু এই বয়সের তরুণ বেকারও আছে। সেই তথ্য জানলে বোঝা যাবে আমরা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি কি না।
গ্রামে মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বাড়ছে শহরে। মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ (৩১.৫১%) নাগরিক এখন শহরে বাস করে; দুই-তৃতীয়াংশ (৬৮.৪৯%) থাকে গ্রামে। সংখ্যায় ১১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন গ্রামে থাকে আর শহরে থাকে ৫ কোটি ২০ লক্ষ ৯ হাজার ৭২ জন। গ্রাম থেকে মানুষ শহরের দিকে ছুটছে। এই পরিসংখ্যান দিয়ে এটা বলা যাবে না যে দেশের উন্নতি হয়েছে, বরং শঙ্কিত হতে হয় যে গ্রামে কর্মসংস্থান এবং জীবন-জীবিকার সংকট দেখা দিয়েছে। কৃষি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর কলকারখানায় সস্তা শ্রমিক হবার জন্যে শহরে এসে বস্তিতে থাকছে যেখানে তাদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার সুবিধাগুলো নেই।
এই জনশুমারির প্রাথমিক ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না, শুধু পদ্ধতিগত কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণেও। দেশের জন্যে সঠিক পরিকল্পনা করতে সঠিক পরিসংখ্যানের বিকল্প নেই। পরিসংখ্যান যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।