আমাদের আয়শা
ফরিদা আখতার / ফরহাদ মজহার || Sunday 11 April 2010 ||আয়শা আক্তার, জন্ম : ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৯ ইং / মৃত্যু : ২৪ ফেব্রুয়ারি , ২০১০
আয়শা আক্তার যেদিন ১৯৯২ সালে নবপ্রাণ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সেদিন থেকেই তিনি মনপ্রাণ দিয়ে একে গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন তার মুল সংগঠকদের একজন। নবপ্রাণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি নবপ্রাণ আন্দোলনের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন তো অবশ্যই, কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে নবপ্রাণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যান্যদের সাথে আয়শা আক্তার নিজেকে যেভাবে উৎসর্গ করেছিলেন তার তুলনা চলেনা।
নবপ্রাণ আন্দোলনের কাছে সংস্কৃতি নিছক বিনোদন নয়। সংস্কৃতি আমাদের সমাজের ভাবুকতা, দার্শনিকতা, চিন্তা, চেতনা, ধ্যান ধারণার প্রকাশ। তার বিকাশের জন্য যে চর্চা সেই ক্ষেত্রে আয়শা আক্তার আবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। নবপ্রাণের সঙ্গে তাঁর নাম এখন সোনার অক্ষরে খচিত হয়ে গিয়েছে।
আয়শা আক্তার নবপ্রাণ আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে বাংলার সাধক-ভাবুকদের গান ভাবপ্রকাশের ঘরানা বজায় রেখে গাইবার ধারা মনে প্রাণে চর্চা করেছেন, অন্যান্যদেরও শিখিয়েছেন। তিনি ফকির লালন শাহ, জালাল উদ্দিন খাঁ, হালিম বয়াতি, খালেক দেওয়ান, রজ্জব আলী দেওয়ান সহ বিভিন্ন সাধকের গান বেশী গাইতেন। আয়শা টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে সাধক এবং কৃষকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে গানের চর্চা করে সময় কাটাতেন। এটাই ছিল তাঁর কাজ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফকির লালন সাঁইজীর গান ও বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে সাধকের গান পরিবেশন করে তিনি শ্রোতাদের মন জয় করতেন অনায়াসে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে নবপ্রাণ আন্দোলনের সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্রে তিনি শিশুকিশোরদের গান শেখাতেন। তাছাড়া ঢাকাতে নবপ্রাণ সঙ্গীত ঘরে ( ৯ / ৪, ইকবাল রোড, ঢাকা) তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের লালন সাঁইজীর গান সাধকোচিত ভাব বজায় রেখে শিক্ষা দিতেন। আয়শা কর্মজীবনে উবিনীগের তথ্য সংরক্ষণ বিভাগের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন। তিনি ওষুধি গাছের চিকিৎসা দেয়া এবং বাচ্চা হওয়ার সময় মহিলাদের কাছে থেকে সেবা দেওয়ার কাজও করেন।
আয়শার গানের খাতার একটি পাতা। আমাদের ছেড়ে চলে যাবার আগে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে আয়শা এই গানটি গেয়েছিল।
পিঞ্জিরার পাখির মত আমি তারে উইড়া যাইয়া দেখি
কোথায় গো আমার কালো পাখি
শিকল কাটিয়া গিয়াছে উড়িয়া গিয়াছে কোন অজানা দেশে
জীবন থাকিতে না পাইলাম দেখিতে
আমার মরণের আর কয়দিন আছে বাকি।।
চলে যাবার ঘন্টাখানিক আগে আয়শা এই গানটি সন্ধ্যায় রিদয়পুর বিদ্যাঘরের দৈন্য গানের আসরে গেয়েছিল। শিল্পী আব্দুল আলীমের গাওয়া এটাই আয়শার জীবনের শেষ গান।
নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের কাছে তিনি ছিলেন অতি জনপ্রিয়। কৃষকেরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় রাসায়নিক সার, বিষ ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে গান বাঁধতেন। আয়শা আক্তার তাদের গান সুর ঠিক করা এবং পরিবেশনায় সহায়তা করতেন। আয়শাকে বাদ দিয়ে কোন কৃষক মেলা বা সমাবেশ কল্পনা করা কঠিন ছিল। তিনি বাংলাদেশ ছাড়াও দেশের বাইরে নেপাল, জাপান ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেছেন। বিদেশে লালন সাঁইজী, হালিম বয়াতি, খালেক দেওয়ান,রজ্জব আলীসহ বিভিন্ন সাধকের গান পরিবেশন করে আয়শা আক্তার হাজার হাজার দর্শক - শ্রোতার মন জয় করেছিলেন
নবপ্রাণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গান ও ভাব চর্চার পথ ধরে আয়শা হয়ে উঠেছিলেন বাংলার নদিয়া পরিমন্ডলের একজন সাধক। দৈনন্দিন জীবনের আচারে আচরণে একজন ভক্ত সাধকের জীবন তিনি যাপন করে গিয়েছেন। অপরের সেবা, সমাজের প্রতি কর্তব্য পালন, পরিবার পরিজনের প্রতি দায়িত্ব ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে শুধু উবিনীগ, নবপ্রাণ, নয়াকৃষি আন্দোলনের মানুষের কাছেই নয়, তাঁর আশেপাশের সকলের কাছেই তিনি ছিলেন একজন সদানন্দময় মানুষ। যাঁর দর্শন ও সঙ্গ মাত্রই ছিল মধুর। তাঁর তিরোধানও ঘটেছে একজন সাধকের মতো। তিনি গান গাইতে গাইতেই সকলের কাছে বিদায় নিয়ে গিয়েছেন। শিখিপড়ি বিদ্যালয়ের শিশুদের তিনি শেখাচ্ছিলেন 'অষ্টক' পালা। তাঁর একটি বাসনার কথা তিনি প্রায়ই বলতেন যে তাঁর সাধনার ক্ষেত্র কোন একটি নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে যেন তিনি চোখ বুঁজতে পারেন। তাঁর আশাই পূরণ হয়েছে শেষাবধি। শেষ বিদায় নিয়েছেন রিদয়পুর বিদ্যাঘর থেকে। ধন্য আয়শা। এই তিরোধান খুব কম সাধকের ভাগ্যেই জোটে। মৃত্যুর আগে আসুস্থ হয়ে অসুস্থ হয়ে মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই তিনি চলে যান। কাউকে তার সেবা করার কষ্ট করতে হয়নি।
শিখিপড়ি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গান ও নাচ শেখাবার জন্য আয়শার চেষ্টার অন্ত ছিল না। একটি চমৎকার অনুষ্ঠানের পরে আয়শা তার একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে হাসিমুখে...
জীবনে লড়াই সংগ্রাম করে আয়শাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তাঁর জন্ম স্থান ছিল মানিকগঞ্জ। পিতা কৃষক নওয়াব আলী শেখ । মা শারজাহান। কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠে আয়শা আক্তার। বড় ভাই আব্দুল জলিল ছিলেন একজন গান প্রেমিক মানুষ। ছোট বেলায় ভাইয়ের কাছ থেকেই তাঁর গানের হাতে খড়ি। স্কুল জীবনে নাটকে অভিনয় করে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ছোট বেলা থেকেই নাচের প্রতি তার খুব ঝোঁক ছিল। সেই সময় ( ষাট দশকে) যাত্রাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ কষ্টকর ছিল। আয়শা আক্তার অন্নপূর্ণা যাত্রায় প্রথমে নৃত্য শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি অনেক যাত্রা পালায় নৃত্য শিল্পীর পাশাপাশি অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ৬০ দশকে অন্নপূর্ণা যাত্রা দলের অভিনেত্রী ছিলেন ।
তার বিখ্যাত কয়েকটি যাত্রা পালার নাম বাবুল অপেরা, শ্রীদৃর্গা ইত্যাদি। তিনি ঘেটু দলে 'আলোমতি প্রেমকুমার' নামে যাত্রায় প্রথম নায়িকা আলোমতির ভূমিকায় অভিনয় করেন। সে সময় আলোমতি চরিত্র এত জনপ্রিয় ছিল যে আলোমতি যে বাঁশ ধরে প্রেমকুমারের জন্য কাঁদতো যাত্রা শেষে সেই বাঁশ ভাল দামে বিক্রি হতো। এমন কি যাত্রাতে যে-পাটাতনে আলোমতি নাচতো সেই পাটাতনও বিক্রি হতো ।
ষাট দশকে মেয়েরা যাত্রায় অভিনয় করলেও তাদের পোশাক আসাক অশালীন ছিল না। অনেক খারাপ জায়গাতে তাদের যাত্রা করতে হয়েছে, কিন্তু সামাজিকভাবে কোন খারাপ অবস্থার শিকার হতে হয়নি।
আয়শা আক্তারের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্য। তিনি বলেন, একবার আলোমতির ভূমিকায় অভিনয় করছি বিশেষ এক দৃশ্যে একজন দর্শক টাকা ছুঁড়ে মারে। টাকা আমার গায়ে লাগে। আমি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করাতে সেই দর্শক প্যান্ডেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই কথা বলে তিনি বর্তমান সময়ের অভিনেত্রীদের ্নিজের সম্মান নিজে রক্ষার আবেদন জানাতেন।
আসাধারণ মেয়ে ছিলেন আয়শা আক্তার। মিরপুর মাজার রোডে তিন শতক জমি তিনি স্কুলের জন্য দান করেন। পরবর্তীতে সেখানে মিরপুর শাহ আলী মডেল হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। নবপ্রাণ আন্দোলনে যোগ দেয়ার আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় তিনি যাত্রা অভিনয় ও নৃত্য পরিবেশন করেছেন। বাবুল অপেরায় তিনি নিয়মিত অভিনয় করতেন।
আয়শা আক্তার দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন। তিনি চার নাতি ও তিন নাতনী রেখে গেছেন।
অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি উবিনীগের টাঙ্গাইল রিদয়পুর কেন্দ্রে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে আমাদের ছেড়ে চলে যান।
আয়শা আমাদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
(এই লেখাটির পেছনে যাঁদের প্রেরণা ও সহায়তা আছে তাঁরা নবপ্রাণ আন্দোলনের ফেরদৌস আখতার লিলি, সীমা দাস সীমু, আব্দুল কুদ্দুস এবং রোকেয়া বেগম। আব্দুল জব্বার ও শামিউল ইসলামের ছবি আমরা ব্যবহার করেছি। তাঁদের অনেক ধন্যবাদ।)