স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নাকি অব্যবস্থাপনা
ফরিদা আখতার || Friday 14 November 2014 ||সম্প্রতি টিআইবির স্বাস্থ্য খাত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন নিয়ে সরকার অখুশি হয়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী। হওয়ারই কথা। এত দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত হাজির করলে এবং তা টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ভাবমূর্তি বলে তো একটা কথা আছে, সেটা ফুটো হয়ে যায়। তাই তথ্য সঠিক কী বেঠিক যাচাই না করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বসেন, এ রিপোর্ট একপেশে। তার চেয়ে ভালো হতো যদি মন্ত্রী মহোদয় সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে দেখে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেন।
আমরা যারা স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করি আমাদের কাছে মনে হয়নি টিআইবির প্রতিবেদনে এমন কোনো নতুন তথ্য আছে, যা আমাদের কিংবা সাধারণ জনগণের জন্য আশ্চর্য হওয়ার মতো। টিআইবি তথ্যগুলো গুছিয়ে দিয়েছে মাত্র। এর আগে এ তথ্য স্বাস্থ্য সাংবাদিক ফোরাম, স্বাস্থ্য আন্দোলনসহ আরও অনেকে নানাভাবে দিয়েছেন। সাংবাদিকরা নিয়মিত স্বাস্থ্য খাতকে নজরদারিতে রেখেছেন। তবে টিআইবি যেহেতু ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে বেশি কাজ করে তাই পত্রিকার শিরোনামে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ঘুষের পরিমাণের ওপর। সাত নভেম্বর তারিখে ডেইলি স্টার লিখেছে, 'Bribe for everything ', নয়াদিগন্ত লিখেছে, 'স্বাস্থ্য খাতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়'- নিয়োগ, বদলি এবং পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত পরিমাণ ঘুষ নেয়া হয়। অ্যাডহক নিয়োগে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা, বদলির জন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ, পদন্নোতির জন্যও পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়া হচ্ছে। এগুলো চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কথা এখানে নাই বা তুললাম। স্বাস্থ্যসেবার জন্য জনবলের প্রয়োজন আছে এবং বিশেষ করে প্রয়োজন সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য মূল ভরসার জায়গা। এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নিতে হলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাই নিতে হবে এবং এ পর্যন্ত এর প্রসার ঘটেছে উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যন্ত। সেদিক থেকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে মানুষের হাতের কাছে সেবা আছে বলা যেত; কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব, সমন্বয়হীনতা মিলে সমাধানের ক্ষেত্রে কঠিন অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যে খাতে সাধারণ মানুষের কষ্টের সময়ে সরাসরি সম্পর্কের ব্যাপার আছে, সেখানে এত সমস্যা থাকবে কেন? এ প্রশ্ন সবাইকেই ভাবায়।
প্রথম চোখে পড়ার মতো সমস্যা হচ্ছে জনবল স্বল্পতা, দক্ষতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় স্থানে না থাকা, নিয়োগের অনিয়মসহ আরও অনেক ধরনের সমস্যা। স্বাস্থ্য জনবল বলতে প্রথমেই মনে হয় ডাক্তারের কথা। যারা ডাক্তার হতে চায় আগে জানতাম তারা সেবার মনোভাব থেকেই এ পেশা বেছে নেন। সমাজে তাদের সম্মান ছিল। ডাক্তার হওয়ার অর্থ ছিল সে ভালো ছাত্র বা ছাত্রী। এখনও তা অনেকখানি সত্যি। বিজ্ঞানে ভালো জ্ঞান থাকা চাই। আমি বলব, এখনও অনেকেই সেবার জন্যই চিকিৎসক হচ্ছেন। তারা এখনও আছেন বলেই হয়তো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা একেবারে ভেঙে পড়ছে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ভালো ডাক্তারের মূল্য কমে যায় বাণিজ্যের চাকচিক্যের কাছে। যারা ভালো ডাক্তার, তারা সব সময় বেশি ওষুধ লেখেন না বা অহেতুক টেস্ট করতে দেন না। অন্যদিকে যারা বাণিজ্যিক চিকিৎসক তারা রোগীর দিকে তাকান না, রোগীকে ভালো করে জিজ্ঞেস করেন না তার কষ্ট কী, শুধু উপসর্গ শুনেই প্রথমে কয়েকটি টেস্টের তালিকা ধরিয়ে দেন। টেস্ট না করলে রোগ নেই, চিকিৎসাও নেই। এসব করতে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক গিয়ে দাঁড়ায় 'টাকা-পয়সা' লেনদেনের ওপর। টাকা না দিতে পারলে তার চিকিৎসা হবে না, যতই তার জীবন বিপন্ন হোক। কিছু ডাক্তারের (কিংবা আজকাল হয়তো সংখ্যার দিক থেকে তারাই বেশি) আচরণের কারণে ডাক্তারের নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে 'কসাই'। কসাই কেন বলা হয় জানি না, সার্জেনের ক্ষেত্রে তা হতে পারে; কিন্তু সব ব্যবসায়ী ডাক্তারের ক্ষেত্রেই ঢালাও কসাই কথাটা প্রযোজ্য কিনা- ভেবে দেখা দরকার আছে। 'ডাকাত' বলা যেত কি?
স্বাস্থ্য জনবলের মধ্যে নার্স বা সেবিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যাদের ছাড়া কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতাল চলে না। সেটা সরকারি হোক বা বেসরকারি। কিন্তু বাংলাদেশ অন্য দেশের তুলনায় বড় অদ্ভুত। অন্য দেশে ডাক্তারের তুলনায় নার্সের সংখ্যা থাকে বেশি, আর বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য পাঁচজন ডাক্তার এবং মাত্র দুজন নার্স রয়েছেন (Bangladesh Health Watch ২০০৭ সালের হিসাবে)। এদিকে সরকারি পর্যায়ে নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স, ডেন্টিস্ট এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা মোট স্বাস্থ্য জনবলের মাত্র ৬ ভাগ। সরকারি ও বেসরকারি প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য জনবল প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে ৭.৭ জন। এ চিত্র খুব সুখের নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২২.৮ জন স্বাস্থ্য জনবল থাকার কথা। বাংলাদেশ খুব দুরবস্থায় আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের ৫৭টি দেশ চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য জনবলের ঘাটতির দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের সঙ্কলিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ১২ জন গ্রাম্য ডাক্তার এবং ১১ জন ওষুধ বিক্রেতা রয়েছে। অর্থাৎ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের তুলনায় ২.৫ গুণ বেশি গ্রাম্য ডাক্তার এবং দুইগুণ বেশি ওষুধ বিক্রেতা আছেন, যাদের কাছে রোগীরা চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। এদিকে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার বাইরে কবিরাজ ও টোটকা চিকিৎসক আছে যথাক্রমে প্রতি ১০ হাজারে ৩১ এবং ৩৩ জন।
দেশে মোট রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সংখ্যা রয়েছে ৫৪ হাজার ৯৭৭ জন, যার মধ্যে দেশে আছেন মাত্র ৪৩ হাজার ৫৩৭ জন। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, দেশে যারা আছে তারা সবাই সরকারি কাজে নেই, আছে মাত্র ৩২.৪ ভাগ। বাকিরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। (স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য, ২০১১)। মোট রেজিস্টার্ড নার্সের সংখ্যা ৩০ হাজার ৪১৮, তার মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার ৭০৯ জন সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত আছেন। এতে বোঝা যায়, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের অভাবে করা যাচ্ছে না।
চিকিৎসকের সংখ্যা বা নিয়োগ নিয়ে অনেক হৈচৈ করলেও দেখার বিষয় হচ্ছে, তারা নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করছেন কিনা। সহজ উত্তর হচ্ছে থাকছেন না। এর জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই। টিআইবি ২০১১-১৩ পর্যন্ত সময়ে জরিপে দেখেছে, একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কর্মস্থলে থাকছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত টিআইবি প্রতিবেদনে এ নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান দেয়নি; কিন্তু এ চিত্র বাস্তবে সবাই দেখেন। এই একই চিকিৎসককে কর্মস্থলে পাওয়া না গেলেও তার বাড়িতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে দেখা যাচ্ছে। ওষুধের দোকানে বসে রাত ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত রোগী দেখতেও তার ক্লান্তি নেই।
টিআইবির প্রতিবেদনে আরও অনেক বিষয়ের ওপর তথ্য থাকলেও ঘুষের কথাটাই বেশি আলোচিত হচ্ছে, কারণ টিআইবি ঘুষের কথা বলবে এটাই ধরে নিয়েছে সবাই। মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য অনেক অব্যবস্থাপনার দিক আছে, যা ঘুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরা গ্রামে একটি পাকা স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপিত হলেই খুশি হয়ে যাই। বাহ, খুব আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হয়ে গেল। দেখা যায়, কিছুদিন পর এখানে পরিষ্কার করার কোনো মানুষ নেই, জনবল নিয়োগ করা হয়নি। দায়িত্ব ও বেতন না দিলে কে পরিষ্কার করে দেবে। দেখা যায় জনবল আছে, বেতনও পাচ্ছে কিন্তু ঝাড়ু কেনার বরাদ্দ নেই। তাহলেও পরিষ্কার হবে না। বাথরুম পরিষ্কার না হলে যে কি দুরবস্থা হয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীরা আসে সুস্থ হতে। সেখানে পরিষ্কার পরিবেশ না থাকলে নিশ্চয় রোগীর রোগ বেড়ে যাবে, কমবে না। ওষুধ সরবরাহ নিয়েও একই কথা। সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি (ইডিসিএল) ঠিকমতো ওষুধ সরবরাহ করলে গ্রামের সাধারণ রোগীদের উপকার হতো। সেখানেও প্রচন্ড অনিয়ম কাজ করছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল হলে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে ছোটে। এবং অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। যদিও ক্লিনিক চলে সরকারি ডাক্তারকে বিকালের সময় নিয়োগ করেই। সরকারি ডাক্তার বিকালে ক্লিনিকে বসে জনগণের সেবার মনোভাব ভুলে গিয়ে ক্লিনিকের মুনাফা অর্জনের জন্য শ্রম দিতে থাকেন। একইভাবে তাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে ডায়াগনস্টিক ব্যবসার এক অশুভ সম্পর্ক। টিআইবি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান; কমিশনের হার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ক্লিনিকগুলো তাদের বিজ্ঞাপনে চিকিৎসকদের অতিরিক্ত যোগ্যতা, ভুয়া পদবি দেখিয়ে বাড়তি সুযোগ নেয়। ৯ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালের নেফ্রলজি আয়ন্ড ডায়ালাইসিস সেন্টারের বিজ্ঞাপনে বিশেষজ্ঞদের নামের সঙ্গে লেখা হয়েছে এমবিবিএস, ইউএসএমএলই, এমআরসিপি (ইউকে) কনসালটেন্ট, নেফ্রলোজি। আমি নিজে ডাক্তার নই, তাই ডাক্তারদের সব পদবি সম্পর্কে পরিচিত নই। কিন্তু দেশের একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টেলিভিশনের একটি টকশোতে বলেছেন, এটি কোনো ডিগ্রি নয় যে, প্রচার করতে হবে। আমি নিজে গুগল সার্চ দিয়ে দেখেছি, এটা নেফ্রলজি চিকিৎসার তিন ধাপের একটি পদ্ধতিমাত্র। চিকিৎসায় ইউএসএমএলই (ইংরেজিতে The United States Medical Licensing Examination) -এর ব্যবহার আছে; কিন্তু পদবি হিসেবে ব্যবহার সেদিক থেকে সঠিক নয়। বিজ্ঞাপনে এর ব্যবহার বাড়তি সুযোগ নেয়ার চেষ্টা মাত্র।
স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সমালোচনা করতে আমাদের কষ্ট হয়। কারণ এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন রোগীরা। গরিব-ধনী সবাই। সরকার সমালোচনায় বিরক্ত না হয়ে স্বাস্থ্য খাতকে গণমুখী করে এ দেশের মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। এটাই তাদের দায়িত্ব।