বিদায় লতিফা আপা, আমরা শোকাহত
সীমা দাস সীমু || Friday 05 December 2014 ||প্রফেসর লতিফা আকন্দ আমাদের মাঝে আর নেই। তিনি গত ৪ ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোরে ঢাকা বার্ডেম হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না....রাজিউন)। তার মৃত্যুতে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০০ টায় ঢাকা বাডেম হাসপাতাল থেকে প্রফেসর লতিফা আকন্দ এর মরদেহ তাঁর নিজ বাসভবনে (৩২ পুরানা পল্টন লাইন, ঢাকা) নেয়া হয়। এবং জুমা নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাজার জন্য নেয়ার পরে বনানী গোরস্তানে সমাহিত করা হয়।
প্রফেসর লতিফা আকন্দ এর নিজ বাস ভবনে সকাল থেকেই তাঁর আত্মীয়, শুভানুধায়ী, সহকর্মী, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, নারী নেত্রী সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
তাঁর দীর্ঘ জীবনের সংগ্রাম ও সফলতা এখানে তুলে ধরছি-
প্রফেসর লতিফা আকন্দ ১৯২৫ সালের ১ নভেম্বর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রখ্যাত ডাক্তার এফ আর খান, কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম মুসলমান ডাক্তার। লতিফা আকন্দ কলকাতার বেগম রোকেয়ার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়ার গালর্স স্কুল থেকে পড়াশুনা করেন। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল থেকে পড়াশুনা কৃতিত্বের সাথে শেষ করে তিনি ভর্তি হন লেডি ব্রের্বোন কলেজে। তিনি ১৯৪৪ সালে বি.এ পাশ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে এম. এ পাশ করেন।
প্রফেসর লতিফা আকন্দ এর স্বামী ডাঃ মুন্সী জামিলউদ্দিন আকন্দের উদার সহযোগিতা ও অগ্রসরমান জীবনকে আরও পরিপূর্ণ সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। ১৯৪৭ সনে ডাঃ আকন্দের বদলির কারণে তাঁকে কলকাতা থেকে করাচি চলে যেতে হয়। সেখান থেকে ফিরে এসে লতিফা আকন্দ ইডেন কলেজে প্রভাসিকা হিসাবে যোগ দেন। তিন বছর পরে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে তিনি ১৯৬১ সনে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি থিসিস সাবমিট করে জানতে পারেন যে, তাঁর থিসিস ডুপলিকেটেড। সুতরাং তাঁর আর ডক্টরেট করা হয় না
দেশে ফিরে বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত লতিফা আকন্দ এ দেশের শিক্ষা ও সুযোগ বঞ্চিত মেয়েদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেন পুরানা পল্টন গালস্ কলেজ। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৮৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এই দীর্ঘকালব্যাপী শিক্ষকতার জীবনে দুঃখ ছিল, আনন্দ ছিল এবং কৃতিত্ব ছিল অনেক বেশী। আরও ছিলো সতীর্থ ও ছাত্র ছাত্রীদের ভালবাসা।
কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেও সমাজে মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ তিনি অনুভব করেছেন। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি সমাজ সেবা করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ প্রতিপালন ও পুনর্বাসন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কাউন্সিলের সদস্য। উইমেন ফর উইমেন’র তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এছাড়াও তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তিনি জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার, বাংলাদেশ ওয়ার ক্যাম্প, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ ও ইতিহাস সমিতির আজীবন সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তিনি কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখা ‘সোসাল হিস্টিরি অব মুসলিম বেঙ্গল’ নামক বইটি এম.এ ক্লাসে পড়ানো হয়।‘ওমেন এন্ড ভায়োলেন্স’ নামক গ্রন্থটিও বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত। তিনি একজন সুবক্তা হিসাবেও বিশেষ সমাদ্রিত ছিলেন।
খেলাধূলাকে তিনি ভালবাসতেন এবং নিজেও খেলাধূলা করতেন। তিনি মনে করতেন প্রতিটি পাড়ায় বা মহল্লায় সরকারি ও বেসরকারি ভাবে খেলাধূলার সুষ্ঠু ব্যবস্থা সম্বলিত কেন্দ্র গড়ে তুলে ছেলে মেয়েদের খেলাধূলার ব্যাপারে উৎসাহি করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে এই সমাজ থেকে দূর হবে হতাশা এবং দূর হবে অন্যান্য ভয়াবহ সামাজিক অনাচার মূলক কর্মকান্ড।
সকালে হাঁটা ছিল তাঁর বহুদিনের অভ্যাস। তিনি রমনা উদ্যানে যে নারীরা সকালে হাঁটতে আসতেন তাদের বিশ্রামের জন্য একটি কর্ণার নির্ধারণ করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন “একটু বসি”। একটু বসি’র সদস্যরা নিয়মিত ব্যায়ম করেন। একটি বিশেষ ব্যায়াম তিনি করাতেন তা ছিল হা হা করে উচ্চ স্বরে হাসি’র ব্যায়ম।
প্রফেসর লতিফা আকন্দ আমাদের মাঝে আগামি দিনের কাজের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। আমরা জানাই তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও লাল সালাম।
(নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’র প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের শত বছরের নারী’ থেকে সংগৃহীত)