স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে চরবাসী মানুষের প্রস্তাবনা
“চরুয়া মান্সের আবার চিকিৎসা!”
আসন্ন ‘স্বাস্থ্য বাজেট ২০১৬ - ২০১৭’ নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হলো কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী থানার মনতলার চরে।
“হামরা গরিব। হামরা চরুয়া। চরুয়া মান্সের আবার চিকিৎসা! কোটে পাও হামরা ডাক্তার”। (আমরা গরিব। আমরা চরের মানুষ। চরের মানুষের আবার চিকিৎসা! কোথায় পাবো আমরা ডাক্তার) এভাবেই কথাগুলো বললেন মনতলা দাই ঘরের দাইমা মাজেদা বেগম।
চরের মানুষ কষ্ট করে স্বাস্থ্য সেবার জন্য হাসপাতালে গেলেও বেশীরভাগ সময় তারা সঠিক চিকিৎসা পায় না। হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না। অনেক সময় বলা হয় ‘ এখন ডাক্তার নাই পরে আস’।
জ্বর, সর্দি হলে নিজেরাই টোটকা করে, গাছ-গাছালির ওষুধ খায়। বড় ধরনের অসুখ হলে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হয় বড় বিরম্বনা। আর গর্ভবতী নারীদের জন্য মহা বিপদ। চরে কোন ডাক্তার নাই। চর থেকে সদরে যেতে হলে পাড়ি দিতে হয় ব্রক্ষ্মপুত্র নদ। সবসময় ঘাটে নৌকা পাওয়া যায় না। নৌকা ভাড়া করতে লাগে অনেক বেশী টাকা। ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা ছাড়া নৌকা ভাড়া পাওয়া যায় না। আর খেয়া নৌকা চলে দিনে রাতে তিন বার। সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায়। রোগীদের জরুরী প্রয়োজনে খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষা করা যায় না। তাই পরিবারের গরু, ছাগল বিক্রি করে রোগীর চিকিৎসা করতে হয়।
চিলমারী চর এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য কথা শোনার জন্যে ২১ এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১০টায় ‘স্বাস্থ্য বাজেট ২০১৬ - ২০১৭’ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় চিলমারী ইউনিয়নের চরে, মনতলা গ্রামে। স্বাস্থ্য আন্দোলন, উবিনীগ ও মনতলা দাইঘর (মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র) যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে। চিলমারী ইউনিয়নের মনতলা গ্রামে অবস্থিত দাইঘরে (মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র) এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
আসন্ন ‘স্বাস্থ্য বাজেট ২০১৬ - ২০১৭’ তে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে এখনও কোন ধারণা পাওয়া যায়নি। গরীব ও নিঃস্ব মানুষ নানাভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষভাবে চর এলাকার মানুষেরা স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োজন অনুসারে পাচ্ছেন না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত গরিব ও অবহেলিত মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কি ধরনে বাজেট হওয়া উচিত তা নিয়েই এই মতবিনিময় সভায় আলোচনা হয়।
এই সভায় উপস্থিত ছিলেন, উত্তম কুমার সরকার, এরিয়া অফিসার, টেরি ডারস্ হোমস (TDH) ফেডারেশন, চিলমারী। উপেন্দ্রনাথ দাস, প্রধান শিক্ষক, মনতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, চিলমারী। মো: সাঞ্জু মিয়া, মেম্বার, মনতলার চর, চিলমারী ইউনিয়ন, চিলমারী। এস এম নূরুল আমিন সরকার, সাংবাদিক, চিলমারী প্রেস ক্লাব। নিসিথ চন্দ্র নায়েক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা, টেরি ডারস্ হোমস (TDH) ফেডারেশন, চিলমারী।
নজরুল ইসলাম সাবু, সভাপতি, চিলমারী প্রেস ক্লাব। নাজমুল হুদা পারভেজ, সাংবাদিক, চিলমারী। শাহানাজ বেগম, পরিবার পরিকল্পনা ভিজিটর, ৫নং চিলমারী। তানিয়া শারমীন, প্যারামেডিক্স, ফ্রেন্ডশীপ, নাজমা খাতুন, ক্লিনিক ইনচাজর্, ফ্রেন্ডশীপ। সিদ্দিকুর রহমান, সাংবাদিক, ভোরের পাতা। আলমগীর হোসেন, ফ্যামেলী প্লানিং ইন্সেপেক্টর। শারমিন নাহার, ফ্যামেলী প্লানিং এ্যাসিসটেন্ট। দাইমা গোলাপজান, আমেছা বেওয়া ও ফুলমতি। ছক্কুমিয়া কৃষক, নয়াকৃষি আন্দোলন। কহিনূর, এফ.সি.এম এইড। সভাটি পরিচালনা করেন সীমা দাস সীমু, স্বাস্থ্য আন্দোলন।
বক্তারা বলেন, চরাঞ্চল জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা কোন পর্যায়ে আছে তা যদি দেখা যায় তাহলো চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৫০ বেডের হাসপাতাল কিভাবে চলছে জানতে হবে। এখানে ডাক্তার থাকার কথা ২৪ জন। বর্তমানে আছে ৪ জন মেডিকেল অফিসার এবং একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এখানে সব ধরণের প্যাথলোজি পরীক্ষার ব্যবস্থা নাই। স্ত্রী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাই। গর্ভবতী নারীদের সিজারিয়ান অপারেশনের ব্যবস্থা নাই। বহুদিন এখানে কোন নরমাল ডেলিভারিরও ব্যবস্থা ছিল না। রোগীরা হাসপাতালে ওষুধ পায় না। কমিউনিটি ক্লিনিক আছে তেলিপাড়ায়, কিন্তু সেখানে কোন ডাক্তার নাই।
এই আসন্ন ‘স্বাস্থ্য বাজেট ২০১৬ - ২০১৭’ সরকারের বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে যে সব খাতে তা হলো-
১. ইউনিয়ন ভিত্তিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র বাড়াতে হবে।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসক থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
২. জনগণ যাতে ওষুধ পায় হাসপাতালে ওষুধের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৩. চরাঞ্চলে যারা স্বাস্থ্য সেবার কাজ করছে তাদের চর ভাতা দিতে হবে।
৪. চরাঞ্চলবাসীদের জন্য রিভার এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. চর ভেদে স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরী করতে হবে।
একজন ডাক্তার বা প্যারামেডিক্স চরে থেকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনা করবে।
৬. চরে যে সব ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া জানে তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য
সেবা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. যেসব বেসরকারী সংগঠন চরাঞ্চলে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন তাদের
সাথে লিয়াজো করে নৌকা সহায়তা দেওয়া সরকারের দরকার।
৮. চরে স্যাটালাইট ক্লিনিক এর জন্য ওষুধের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এতই কম ওষুধ দেওয়া হয় ১০/১২ জনকে ওষুধ দেওয়া যায়।
তাও সম্পূর্ণ ডোজ দেওয়া যায় না।
৯. চরে উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন গর্ভবতী নারীদের জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ থাকতে হবে।
১০.স্যাটালাইট ক্লিনিক পরিচালনার জন্য চরে স্থান পাওয়া যায় না। চরের মানুষ এতই গরিব তাদের বাড়িতে একটা চেয়ার বা টেবিল নাই। কাজ করতে অসুবিধা হয়। এই কাজ পরিচালনার জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকা দরকার।
আরো জানতে দেখুন: http://ubinig.org/index.php/networkdetails/showAerticle/2/131/bangla