মোরগমুরগির বৈচিত্র ও নয়াকৃষিতে নতুন জাত সংযোজন
মাত্র পঁচিশ বছরের মধ্যেই কৃষকের ঘরের মোরগমুর্গির জাতের বৈচিত্র ক্ষয় পেল।
এই দেশের মানুষকে ডিম আর মোরগ-মুরগির সরবরাহ দিয়ে এসেছে কৃষক পরিবার। বদ্ধঘরে কারখানার মডেলে মুর্গিপালনের আবির্ভাব ঘটেছে সম্প্রতি। বাংলাদেশে আধুনিক পোল্ট্রি খামারের আবির্ভাব গত শতাব্দির নব্বই দশকের শুরুর দিকে। খুবই দ্রুত দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়নের অর্থ খরচ করে নতুন একটি বেসরকারি বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্র হিসাবে একে গড়ে তুলতে গিয়ে দেশী জাতের মুর্গির বিলুপ্তি যেমন ত্বরানিত করা হয়েছে, তেমনি পশুপাখি পালনের জন্য যে প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের জ্ঞান দরকার, তারও ক্ষয় ঘটেছে দ্রুত। জমি ব্যবহারের ধরণেও গুণগত পরিবর্তন এসেছে। চরে খাওয়া মোরগমুর্গির জাতও হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশের মোরগমুর্গির জাতের বৈচিত্র (genetic and biological) খুবই সমৃদ্ধ। বলা হয় এই ভূখণ্ড, বিশেষত পার্বত্য এলাকা থেকেই মোরগমুর্গিকে গৃহপালিত করে তোলা এবং তাদের বৈচিত্র বৃদ্ধির সূত্রপাত ঘটেছে বাংলাদেশে। কারণ বুনো বা জংলি মোরগ -- ইংরেজিতে যাকে Red Jungle Fowl (Gallus gallus) বলা হয় তার আবাস বাংলাদেশেই।
বিদেশী জাতের মোরগমুর্গির সঙ্গে দেশী জাতের প্রতিযোগিতা এবং পরিণতিতে দেশী জাতের পরাজয় রীতিমতো লর্ড ক্লাইভের বিরুদ্ধে সিরাজ উদ্দৌলার লড়াইয়ের মতো। পরিণতিতে দেশী জাতের দ্রুত বিলুপ্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঔপনিবেশিক আমলে ১৯৩৫ সালে প্রথম বিদেশী তথাকথিত ‘উন্নত’ জাতের মোরগমুর্গি আমদানি করা হয়। পাকিস্তান আমলে ছয়টা পোল্ট্রি ফার্ম ডিম ও মাংসের জন্য উৎপাদন শুরু করে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ১৯৬৪ সালে Eggs and Hens Limited কোম্পানি পোল্ট্রি উৎপাদন শুরু করে।এখান থেকেই আধুনিক পোল্ট্রি উৎপাদন শুরু। বাংলাদেশে উন্নত জাতের মোরগমুরগির আমদানি শুরু হয় সরকারের মাল্টিপ্লিকেশান কর্মসূচির জন্য। যেমন, হোয়াইট লেগ হর্ন, রোড আইল্যান্ড রেড, ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে সাভারে বাণিজ্যিক ভাবে পরিচালিত বাংলাদেশ বিমানের পৌলট্রি কমপ্লেক্স কমবেশী সকলের পরিচিত। এতা চালাতো একটি কানাডিয়ান কোম্পানি।
বাণিজ্যিক ভাবে আধুনিক পোল্ট্রি ফার্ম গড়ে ওঠার পেছনে ব্যবসায়িক প্রণোদনা থাকলেও জবরদস্তি করেই বিদেশী কম্পানির পেটেন্ট করা বিদেশী মোরগ ও মুরগির জাত দ্রুত প্রবর্তন করা হয়। এর ফলে দেশীয় জাতের কী ক্ষতি হতে পারে এবং তাদের সংরক্ষণ কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে খুব কমই চিন্তা ভাবনা করাহয়েছে। যথারীতি এনজিওরা দারিদ্র্য বিমোচনের নামে বিদেশী জাত প্রবর্তন ও আধুনিক পোলট্রি সেক্টর বিকাশের কাজে নেমে পড়ায় দেশী জাতের বিলুপ্তি ঘটানো ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশে দেসী জাতের বিলুপ্তি ত্বরান্বিত করবার পেছনে এনজিওদের ভূমিকা রয়েছে।
দেশী মুর্গির বৈচিত্র্যের ক্ষয়ের শুরু অবশ্য পাকিস্তানী আমলে ষাটের শুরু থেকেই। ‘উন্নত’ বিদেশী জাতের মোরগ-মুর্গি প্রবর্তনের মধ্য দিয়েই কৃষকের ঘরে পালা মুর্গির জাত ক্ষয়ের আরম্ভ বলা যায়। পাঁচ দশকের মধ্যে আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি সেখানে দেশী মুর্গির মধ্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন জাত শনাক্ত করা কঠিন। দেশী জাত নামে একটা মিশ্রণ তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যেহেতু এই কাজে অবহেলা করেছেন তাই তারা ‘দেশী জাত’ নামে একটা মিশ্রিত জাতের কথা বলে আমাদের এখন বুঝ দিয়ে থাকেন। যেহেতু মুর্গির জাত নিয়ে গবেষণা হয়নি বললেই চলে সে কারণে এখনকার ‘দেশী মুর্গি’র বিবর্তন কোথায় কিভাবে ঘটেছে তা নির্ণয় করা কঠিন।
নয়াকৃষির শুরুর পর্যায়ে নব্বই সালের দিকে আমরা শুধু টাঙ্গাইলেই প্রায় ১৮টি জাতের সন্ধান পাই। তাদের জিনগত পার্থক্য (genetic variability) জানবার উপায় না থাকলেও তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্য নির্ণয়ের চেষ্টা আমরা করি। এই পার্থক্যগুলো হচ্ছে, (১) তাদের বাহ্যিক রং, আকার ও স্বভাব, যেমন, পালকের রঙ, শরীরের তুলনায় ডানা ও পুচ্ছের আকার ও আয়তন, (২)তাড়ালে উড়ে পালাবার চেষ্টা ও উড়ে পালনর ক্ষমতা, (৩) খাদ্য ও খাদ্য সংগ্রহের ধরণ (৪) মুর্গি ছানাকে চিল-শকুনের হাত থেকে রক্ষার ক্ষমতা (৫) ডিম পাড়ার আগ্রহ ও ডিম পাড়ার সময় আচরণ -- বিশেষত ডিমে তা দিতে আগ্রহী হওয়া বা না হওয়া এবং গড়ে ডিম দেবার সংখ্যা (৬) সন্ধ্যায় গাছে চড়ে থাকা বা না থাকার প্রবৃত্তি, ইত্যাদি আমরা লিপিবদ্ধ করি। সেই দিক থেকে আমলে নেবার মতো দৃশ্যমান পার্থক্যের দিক থেকে আমরা প্রায় ১৮টি জাত শনাক্ত করি।
এই অভিজ্ঞতার পর নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা কক্সবাজার জেলার সমতল ও পাহাড় থেকে পদ্মাবতী কেন্দ্রে বিভিন্ন মুর্গির জাত সংগ্রহ করে । দুর্ভাগ্য হোল সম্প্রতি ২০১৫ সালের পাহাড়ি ঢলের বন্যায় নয়াকৃষি পদ্মাবতী বিদ্যাঘরে সংরক্ষিত এই জাতগুলো ভেসে চলে যায়। তবে এই জাতগুলো সম্পর্কে তথ্য আমাদের রয়েছে, যা আলাদা ভাবে প্রকাশ করা হবে। এখানে বাহ্যিক পার্থক্য বিচার করে যে জাতগুলো আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি বলে মনে করি তাদের নাম উল্লেখ করা হোল:
(১) দাতাল (২) ঝিনুকা (৩)ঝারুয়া (৪)উট (৫)বইন্যা (৫) জড়া (৬) সোনাপায়া (৭) দুম্বা (৮) চিতা (৯) রাখাল (১০) বেনা (১১) ঝুঁটি (১২)ময়ুরী (১৩) হেজা (১৫) লেংড়া (১৭) ছাইয়া (১৮) কোকিলা (১৯) হাঁসাহেজা (২০) সিংহ (২১) ঝুঁটিমোছা (২২) হিলি (২৩) মোয়াল্লা (২৪) ঠেড়ি (২৫) জিরাফ (২৬) ঘিলা (২৭ ) শিকারি বা বইন্যাশিকারি (২৮) ঘোড়া (২৮) ইয়াসিন (২৯) রূপসী (৩০) জুম্মা (৩১) নাথ বা কেরে নাইত্যা (৩৩) ধলি (৩৪)কেঁচু এবং (৩৫) দেশী বা পাতি (৩৬) ভীমরাজ (৩৭) গিলা (৩৮) টাইগার (৩৯) মুসা (৪০) সোনালিজারা (৪১) তালুকদার (৪২) সোনালি মোয়েল্লা (৪৩) গিলা ইত্যাদি।
এখানে যে জাতকে বিজ্ঞানিরা এখন ‘দেশী’ বলছেন তা একটি আলাদা জাত হিসাবে কৃষকরা শনাক্ত করেন। যদিও নব্বইয়ের শেষের দিক থেকেই আমরা দেখেছি বিজ্ঞানীরা পাঁচ- ছয়টি জাতের বেশী খবর আমাদের দিতে পারছেন না। কারণ দেশী মোরগমুর্গির জাতের বৈচিত্র্য সন্ধান ও সংরক্ষণ তাদের গবেষনায় অগ্রাধিকার পায় না। যে কয়টির কথা আমরা শুনি তারা হোল, (১) দেশী, (২) গলাছিলা (৩) আসিল ও (৫) পাহাড়ি। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি বিজ্ঞানীরা এখন যেভাবে বাংলাদেশে শুধু তিন থেকে পাঁচটি জাতের কথা বলে থাকেন তা বাংলাদেশের মোরগমুর্গির জাতের বৈচিত্র্য বুঝতে খুব একটা সহায়ক নয়। কৃষকের লোকায়তিক অথচ হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জ্ঞান আজ অবধি অবহেলিত হয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়েও মোরগমুর্গির বৈচিত্র্যকে বিজ্ঞানীরা গড়ে হরিবোলে ‘দেশী’ বলে চালিয়ে দিলেও প্রাণবৈচিত্রের দিক থেকে এরা যে অমূল্য সম্পদ এটা তাঁরা স্বীকার করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ওয়েবসাইটের একটি লেখাতে বলা হচ্ছে এখনও দেশী জাতের মোরগমুর্গি্র বৈচিত্র কম নয়; প্রাণ সম্পদ হিসাবে যা অমূল্য। একে রক্ষা করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি খাতে আধুনিক পোল্টট্রি ইন্ড্রাস্ট্রি বিদেশী দান-খয়রাতের কল্যানে বাংলাদেশে গড়ে উঠল দ্রুতই। কিন্তু সে্টা প্রাণসম্পদ রক্ষার কোন নীতি ও পরিকল্পনা ছাড়া। সারা দেশের মানুষকে ডিম, দুধ আর গোশত সরবরাহ করত গ্রামের কৃষক পরিবার। সেই ক্ষেত্রে কৃষক নারীর ভূমিকা ছিল প্রধান। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার কারণে একদিকে প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষয় ঘটল দ্রুত। অন্যদিকে পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে ওঠার কারণে কৃষকের ঘরের মোরগ মুরগির সংখ্যা ও জাতের বৈচিত্র্য দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করল।
নয়াকৃষি আন্দোলনে আমরা তখনও লড়ছি আমাদের দ্রুত হারিয়ে যাওয়া ধান ও ফসলের জাত সংগ্রহ, রক্ষা ও পুনরায় প্রবর্তনের দুরূহ কাজে। এটা একাই ছিল এক বিশাল কাজ। প্রায় নিঃসঙ্গ ভাবে বিষ, সার ও মাটির তলা থেকে পানি তুলে আধুনিক চাষের বিপরীতে একাই আমাদের এই কাজ করে যেতে হয়েছে। গৃহপালিত বা আধা-গৃহপালিত পাখি ও প্রাণির প্রতি নজর নিবিষ্ট করবার মতো সামর্থ আমাদের ছিল না। বিষাক্ত খাদ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা ধান আর সব্জির প্রতি যতোটা আগ্রহী ছিলাম, ততোটা মুর্গি বা গরুছাগলের প্রতি মনোযোগী হতে পারি নি। কিন্তু তারপরও নয়াকৃষির কৃষকদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুপাখি আমরা যতোটা সম্ভব শনাক্ত, সংগ্রহ ও ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে আধুনিক পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে ওঠার তাৎক্ষণিক কুফল হিসাবে কৃষকের ঘরে পালা মোরগ মুর্গির সংখ্যা ও জাত দ্রুত কমতে শুরু করল। পরিবেশ বিষাক্ত হবার কারণে আগে যতো সহজে হাঁসমুর্গি পালন করা যেতো, ক্রমে তা কৃষকের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। আগে ঘরে ঢেঁকিতে ধান ভানার অনুষঙ্গ হিসাবে যে খুদকুঁড়া পাওয়া যেতো তাতেই প্রায় প্রতি কৃষক পরিবারে চরে খাওয়া দশবিশটা মোরগ মুরগি পালা সহজ ছিল। কৃষকের সন্তান সেইসব দেখভাল করতে পারত। অভিজ্ঞরা আর্থিক ভাবেও সফল হতে পারত। এখন সেই স্থান নিয়েছে আধুনিক ধানকল। কৃষক পরিবারের ক্ষয় ত্বরান্বিত হোল। তারা বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের পাঠাতে শুরু করল মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে কন্সট্রাকশান কম্পানির নব্য দাস হিসাবে, আর কিশোরি মেয়েদের পাঠাতে বাধ্য হোল রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরি কারখানার কারাগারে; অনেকে আবার পুড়ে মরল, অনেককে জীবিত অবস্থাতেই কবর দিয়ে দেওয়া হোল। তথাকথিত উন্নয়ন একটি সহিংস প্রক্রিয়া। জমি থেকে কৃষকের সন্তান সন্তন্তিদের ঘর থেকে বের করে এনে সস্তা শ্রমিক বানানো ছাড়া পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশঘটতে পারে না। পোশাক তৈরি কারখানার ভায়োলেন্স বুঝতে হলে গ্রামীন উন্নয়নের ভায়োলেন্স বোঝা জরুরী।
নয়াকৃষি ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রি
বাংলাদেশের পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রি ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর পর দুটো বড় বড় ধাক্কা খেলো এভিয়ান ফ্লুর। দুই হাজার সাত সালে যেখানে পোল্ট্রি খামারির সংখ্যা ছিল ১,১৫,০০০ সেখানে ২০১৩ সালে এসে দাঁড়ালো ৫৫,০০০। এভিয়ান ফ্লু ছিল আধুনিক পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য সতর্ক সংকেত। বড় বড় মুর্গি কম্পানির প্রচার প্রপাগাণ্ডার পরেও দেখা গেলো আধুনিক পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রিই আসলে এই রোগের জন্য দায়ী। যদিও মাইগ্রেটরি বার্ড বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া পাখিকে দোষারোপের চেষ্টা চলল এবং এই ফাঁকে খামারে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার অজুহাত তুলে ছোট ছোট খামারিদের মোরগ-মুরগি পালন কঠিন করে তুলল। এভিয়ান ফ্লুর আতংক থেকে লাভ হোল বড় বড় পোল্ট্রি কম্পানি যাদের অধিকাংশই বহুজাতিক। বাংলাদেশের মোরগ-মুর্গির খাত কৃষকের ঘর থেকে চলে গেল বড় বড় কম্পানির হাতে।
উবিনীগের পদ্মাবতী বিদ্যাঘরে বিভিন্ন জাতের মোরগমুর্গি। যে সকল জাত এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তাদের সংগ্রহ, পালন ও গ্রামে গ্রামে কৃষকের ঘরে বংশ বিস্তার নিশ্চিত করা জরুরী।
এই বাস্তবতার মধ্যেই আমরা আবার দেশীয় জাতের হাঁস-মুর্গি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে লালন পালনের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া জরুরী ভাবতে শুরু করি। নয়াকৃষির কারণে নয়াকৃষির পরিবেশের মধ্যে সেটা আধুনিক কৃষি ও আধুনিক পোল্ট্রি খামারিদের তুলনায় কঠিন ছিল না। ধীরে ধীরে তাকে আরও উন্নত নয়াকৃষি পদ্ধতিতে রূপান্তরের কাজে হাত দেই। কৃষকের খাতে আবার মোরগ-মুর্গি পালন ফিরিয়ে আনা একটি চ্যালেঞ্জও বটে। কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক সার ও বিষমুক্ত কৃষি ব্যবস্থার বিকাশের জন্য এর কোন বিকল্প নাই। শস্য প্রবর্তনায় আমরা কৃষকের ঘরে পালিত দেশীয় মোরগ-মুরগি সরবরাহের ব্যবস্থা করি যাতে কৃষক তাদের উদ্যাগ থেকে আশানুরূপ লাভ পেতে পারে। জাতের বৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে যার কোন বিকল্প নাই। কিন্তু এর চাহিদা যতোই বাড়তে থাকল ততোই আরো অধিক সংখ্যায় শহরে তা সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা আমাদের ভাবতে হোল।
পোল্ট্রি মুর্গি স্বাস্থ্যের জন্য আদৌ কতোটা নিরাপদ তা এখনও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। পোল্ট্রি ফিড তার জন্য দায়ী, এটা কমবেশী প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বদ্ধ অবস্থায় কৃত্রিম ভাবে পালন করা ইন্ড্রাস্টড়িয়াল পোল্ট্রি নিজেই একটা সমস্যা, যা স্বাভাবিক প্রাণের বিকাশের বিরোধী এবং মোরগ-মুর্গির অসুখ বাঁধানো ও বিস্তৃতির প্রধান কারণ।
এই উপলব্ধি থেকেই দুনিয়াব্যাপী ‘অর্গানিক’ বা জৈব পদ্ধতিতে মোরগমুর্গি পালনের রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে মোরগ-মুর্গি সব সময়ই প্রাকৃতিক বা তথাকথিত ‘অর্গানিক’ই ছিল আধুনিক পোলট্রি ইন্ড্রাস্ট্রির কৃষকের খাত ধ্বংস করবার পর আমাদের হুঁশ হতে শুরু করেছে। এখন আমরা দোকানে গিয়ে দেশী মুর্গি চাই, ফার্মের মুর্গি নিরাপদ না এটা বুঝি, স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে খেতে চাই না।
ইন্ড্রাস্টিয়াল পোল্ট্রির জাত সম্পর্কে কিছু মিথ
নয়াকৃষির মোরগমুর্গি পালন ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণের এটাই সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট। কৃষকের জাত কৃষকের ঘরে উন্নত ব্যবস্থাপনায় লালন পালনের পাশাপাশি নতুন গবেষণা ও প্রাণের স্বতঃস্ফুর্ততা প্রমাণের জন্য আমরা কিছু মিথ বা প্রপাগাণ্ডা ভাঙবার কাজও হাতে নিয়েছি। কারণ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রি প্রাণ ও প্রকৃতির সম্বন্ধকে মিস্টেরিয়াস ও রহস্যময় করে তোলে, যা ভাঙা জরুরী।
মিথ নম্বর এক:
ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রিতে যেসকল জাত পালন করা হয় তাকে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক উপায়ে পালন সম্ভব না। তাদের বদ্ধ ঘরেই পালন করতে হবে।
এটা ঠিক যে কিছু কিছু জাত রয়েছে যাদের তৈয়ার করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রির জন্য। আসলে বদ্ধ ঘরে পালন করবার মূল কারণ হচ্ছে বিশেষ ভাবে তৈরি করা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফিড বা মুরগির খাবার খাইয়ে মুর্গির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটানো।
নতুন জাত বা হাইব্রিড হোক যেহেতু প্রাণ অতএব যে কোন জাতের মুর্গিই স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ভাবে পালন সম্ভব। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রির জন্য যেসকল পোল্ট্রির জাতের প্রচলন হয়েছে তারা মাংস বা ডিমের জন্য। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে তাদের দ্রুত বাড়বার কিম্বা বড় সাইজের বেশি ডিম পাড়বার জন্য হরমোন-ভিটামিন সমৃদ্ধ বিশেষ ফিড খাওয়াতে হয়। স্বাভাবিক ভাবে চরে বেড়াতে দিলে তাদের মাংসের বৃদ্ধি কম হতে পারে, কিম্বা মুর্গি কম বা ছোট আকারের ডিম পাড়তে পারে, কিন্তু সতর্ক থেকে স্বাভাবিক ভাবে চরিয়ে মুর্গি পালন করা যাবে অবশ্যই।
মিথ নাম্বার দুই
যে সকল আধুনিক বা হাইব্রিড জাতের মুর্গি ইন্ট্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রির কারণে প্রচলিত তাদের অসুখবিসুখ বেশী, তাদের বদ্ধ ঘরে প্রতিদিন এন্টিবায়োটিক দিয়ে পালতে হবে।
এটা ঠিক যে দেশী মুর্গির রোগ প্রতরোধ ক্ষমতার তুলনায় অনেক আধুনিক ও হাইব্রিড জাতের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এই জাতগুলো আসলে বদ্ধ ঘরেই দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাই তাদের ক্রমাগত এন্টিবায়োটিক দিতে হয়। এন্টিবায়োটিক দেওয়া ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল মোরগ-মুর্গি তাই কখনই নিরাপদ দাবি করতে পারে না। তাকে সরকারী স্টান্ডার্ড অনুসরণ করতে হয়। যার মানে হোল ক্ষতিকর হলেও কোম্পানির স্বার্থ অনুযায়ী কিছু পরিমান এন্টিবায়োটিক ও হরমোন তাদের মাংসে থাকবেই। থাকলেও তাকে আইনত ‘নিরাপদ’ বলা হয়। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে এই দাবি বিতর্কিত। কারন ‘নিরাপদ’ দাবির ভিত্তি বিজ্ঞানের চেয়েও কম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা খাদ্য নিরাপত্তা আইন বা মানদণ্ড। স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে পালিত মোরগ মুর্গির চেয়ে তারা ‘নিরাপদ’ দাবি করতে পারে না।
মিথ নাম্বার তিন:
আধুনিক বা হাইব্রিড জাতের মুর্গি সবুজ খাদ্য অর্থাৎ ঘাসলতাপাতা খায় না, তাদেরকে শুধু কম্পানির পোল্ট্রি ফিডই খাওয়াতে হবে।
নয়াকৃষি পদ্ধতিতে মোরগমুর্গি -- যে জাতেরই হোক সবুজ ঘাস, লতাপাতা, ওষুধি গুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ এভাবেই প্রতি তিন থেকে চার ঘণ্টা অন্তর দেওয়া হয়। দেখা যায় কিছু জাতের মুর্গি এভাবেই খেতে পছন্দ করে, আর কিছু জাত নিজে মাঠে বা ক্ষেতে চরে নিজেই নিজের খাদ্য বেছে নেয়। দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী জাতের মোরগমুর্গি বেড়ে ওঠার প্রথম দিকে এইভাবে খেতে পছন্দ করলেও, একটু বড় হয়ে গেলে নিজেরাই চরে খেতে চায়।
বিদেশি জাতের মোরগমুর্গিকে শুধু কম্পানির পোল্ট্রি ফিডই খাওয়াতে হবে এটা একদমই বাজে কথা। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কোম্পানির ফিডে নানান ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হয়। অথচ মোরগমুর্গির খাদ্য কৃষক ঘরেই বানাতে পারে। চরে খেতে শুরু করলে মোরগমুর্গিকে বাড়তি খাবার দিতে হয় না, এতে খরচের সাশ্রয় হয়। নয়াকৃষিতে এটা খুবই সুবিধাজনক, কারন এই পদ্ধতিতে আপনা আপনি স্বাভাবিক ভাবেই মোরগমুর্গির জন্য প্রচুর খাদ্য আলানে পালানে থাকে।
এছাড়া মুর্গি অবশ্যই খাদ্য হিসাবে সবুজ লতাপাতা পছন্দ করে। বিভিন্ন সব্জিও মুর্গির প্রিয়। জাতভেদে মুর্গির খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেও বৈচিত্র আছে। চরিয়ে লালন পালন করা ও বেড়ে ওঠা মোরগমুর্গিকে কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করলে সেই পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। মোরগমুর্গির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবার জন্য মরিচ খেতে দেওয়া গ্রামের কৃষকদের অনেক কাল ধরেই জানা একটি পদ্ধতি। যে জাত কৃষক পালন করতে চায় তার উপযোগী খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা কৃষকের জন্য মোটেও কঠিন কাজ নয়। দরকার ঘনিষ্ট নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা। এভাবেই হাজার বছর ধরে কৃষক পরিবার পশুপাখি পালন করেছে।
মিথ নাম্বার চার
কৃত্রিম খাবার না দিয়ে সম্পূর্ণ নয়াকৃষি পদ্ধতিতে জৈব ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশী জাতের মোরগমুর্গির মতো লালন পালন করলে তা অধিক নিরাপদ হবে কিন্তু মুর্গির ডিম ও মাংসের স্বাদ ও পুষ্টি ফার্মের মুর্গির মতোই হবে।
এটা ঠিক নয়। জাত ভেদে দেশী জাতের মুর্গির ডিম বা মাংসে স্বাদে যেমন হয়, দেশী বা সংকর জাতের মুর্গির স্বাদেও জাত ভেদে পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু তা কোনভাবেই ফার্মের মুর্গির ধারে কাছে হবে না। হয়ও না। মোরগমুর্গির জন্য নয়াকৃষির খাদ্য ব্যবস্থার কারণে তার পুষ্টিগুণ যেমন উন্নত হবে একই ভাবে তার স্বাদও অনন্য হবে। এর মূল কারণ হচ্ছে
১. বাচ্চা অবস্থায় রোগ প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন ছাড়া নয়াকৃষি পদ্ধতিতে কোন প্রকার এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় না। রোগ প্রতিরোধের জন্য জৈব পদ্ধতিতে বিশেষ ধরণের খাবার তৈরি করা হয়। খাবার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মোরগমুর্গির স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়।
২. দেড় থেকে দুই সপ্তাহের পর থেকেই বাচ্চামুর্গিকে বদ্ধ না রেখে চরিয়ে খেতে উৎসাহিত করা হয়। এর ফলে প্রাকৃতিক আলোহাওয়া ও ঘোরাফেরার কারণে রোগ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতা তারা অর্জন করতে থাকে।
৩. তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই বাচ্চা মোরগমুর্গি পুরাপুরি চরিয়ে খেতে পারে এবং পোকামাকড় কীটপতঙ্গ থেকে নিজেরাই প্রচুর দরকারি প্রোটিন ও অন্যান্য জরুরী উপাদান সংগ্রহ করতে পারে। ফার্মের মুর্গিকে মাছের শুঁটকি দেওয়া হয় যার মধ্যে কীটনাশক থাকে। কিন্তু নয়াকৃষি পদ্ধতির মোরগমুর্গি পালনের ক্ষেত্রে ফসল জাতীয় প্রোটিন ছাড়া বাড়তি কোন মাছ বা মাংস জাতীয় প্রোটিন জাতীয় খাবার দিতে হয় না। মোরগমুর্গি চরিয়ে কীটপতঙ্গ থেকেই সেটা তাদের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী মিটিয়ে নিতে পারে।
৪. এ ছাড়াও তাদের আলাদা করে বিশেষ ধরণের ঘাস ও ওষুধিগুণ সম্পন্ন লতাপাতা দিনের বেলায় তিন ঘন্টা অন্তর দেওয়া হয়। প্রায় সব জাতের মুর্গি তা খুবই পছন্দ করে। সবুজ জাতীয় খাদ্য তাদের সুস্থ ও সবল রাখে, যা পোলট্রি ফার্মে দেওয়া হয় না।
স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার এই চারটি প্রধান কারণে নয়াকৃষিতে কোন প্রকার কৃত্রিম বা বাজারের খাবার ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। কৃষক্রাই সেই খাবার তাদের জমির উৎপাদন থেকে তৈরি করতে পারেন। নয়াকৃষি পদ্ধতিতে লালন পালনের কারনে মোরগমুর্গি স্বাভাবিক ভাবে বাড়বে।
৫. মোরগমুর্গি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হবে।
নয়াকৃষি শুধু দেশীমুর্গির জাতে নিজেদের সীমিত রাখছে না কেন?
নয়াকৃষির সামনে বড় দুটো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রাণবৈচিত্রভিত্তিক খামার ব্যবস্থায় আমরা খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারব কিনা। দ্বিতীয়ত বাজার ব্যবস্থার প্রতিযোগিতায় কৃষক পরিবারকে অর্থনৈতিক ভাবে টিকে থাকলে হলে তার গার্হস্থ্য বিদ্যাকে কিভাবে শক্তিতে পরিণত করা যায়। একে আমরা বলি প্রাণ সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্রের গার্হস্থ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা যাতে বাজার ব্যবস্থার প্রতিযোগিতায় কৃষক হেরে না যায়। এই ক্ষেত্রে কৃষকের পরিবারের বিদ্যমান জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শ্রমকে আরও সুশৃংখল ভাবে কাজে লাগাতে হবে। সারকথায় তার গার্হস্থ উৎপাদন ব্যবস্থাকে দক্ষ করেতুলতে হবে।
স্থানীয় জাতের মোরগমুর্গি কৃষকের ঘরে লালনপালন ও সংরক্ষণ আমাদের গবেষণায় এবং কৃষক পরিবারভিত্তিক মোরগমুর্গি পালনে সবসময়ই অগ্রাধিকার পাবে এবং পাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে গবেষণাও অব্যাহত রয়েছে। কৃষক পরিবারের কাছ থেকে স্থানীয় জাতের মোরগমুর্গি আমরা নিয়মিতই শস্য প্রবর্তনার মাধ্যমে সরবরাহ করছি। কৃষকরাও গ্রামের হাটেবাজারে তা বিক্রয় করছেন। এই কর্তব্য তো রয়েছেই। কিন্তু বাজার ব্যবস্থায় বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য ও একচেটিয়া ভাঙতে হলে উৎপাদনে কৃষক পরিবারকে আরও দক্ষ, ব্যবস্থাপনার দিক থেকে আরও সুশৃংখলা ও গুণগত মান উন্নত করার দিকে আরও অনেক নিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
যে সকল জাত বাইরে থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে আমরা চাই বা না চাই তারা আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে। এর সুবিধা পোল্ট্রি ফার্ম অর্থাৎ কোম্পানি নিচ্ছে, কৃষক নয়। সরকারের নীতি কৃষক বিরোধী কিন্তু কোম্পানি বান্ধব। মোরগমুর্গির ক্ষেত্রে নতুন জাতগুলো নয়াকৃষিতে আত্মস্থ করা যায় কিনা সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এই জন্যই বাইরে থেকে আসা জাত নয়াকৃষি পদ্ধতিতে লালন পালন কতোটা সম্ভব আমাদের তা যাচাই করে দেখতে হচ্ছে।
ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পোল্ট্রি কেন্দ্র করে যেসকল ভূয়া মিথ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তৈরি করে তা ভেঙ্গে দিয়ে ভোক্তাদের সচেতন না করলে আমরা নয়াকৃষির প্রাণ ব্যবস্থাপনায় নতুন জাতের আত্মীকরণ ঘটাতে পারব না। উপযুক্ত গবেষণার মাধ্যমে ভাল জাত আত্মীকরণ করতে ব্যর্থ হলে পোল্ট্রি ইন্ড্রাস্ট্রির সঙ্গে কৃষক পরিবার প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না। এর মধ্য দিয়েই আমাদের জাত যেমন রক্ষা করতে হবে একই ভাবে নতুন জাত আবিষ্কার করে প্রাণবৈচিত্র বৃদ্ধি খুবই দরকারী কাজ। নতুন জাতের আত্মীকরণ এমন ভাবে হতে হবে যাতে একটি কৃষি পরিবার অনায়াসেই ৫০ থেকে একশ মোরগ ও মুর্গি পালন করতে পারে। যাতে কৃষক পরিবার আমাদের জাতীয় চাহিদা মেটাবার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। এতে ডিম, মাংসের সবরাহ যেমন বাড়বে একই সঙ্গে কৃষক জাতের বৈচিত্র রক্ষার পাহারাদার হয়ে উঠবে। পাশাপাশি কর্তব্যের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয় আমাদের এখনকার প্রাণবৈচিত্র সংকট মোকাবিলা এবং ভোক্তাদের সম্পূর্ণ নিরাপদ ওপুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। এই ক্ষেত্রে নয়াকৃষির নীতি হচ্ছে:
এক. প্রাণসম্পদ ও প্রাণের বৈচিত্র্য রক্ষাকে সবসময় অগ্রাধিকার দেওয়া। দেশী হোক কি বিদেশী জাত, প্রাণ মাত্রই প্রাণ ব্যবস্থাপনায় সাড়া দেয় এবং স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ভাবে সেই প্রাণের লালন পালন সম্ভব এই সত্য বারবার প্রমাণ করা জরুরী।
দুই. নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক পরিবার ভোক্তাদের সচেতনতা ও সক্রিয় সহযোগিতার মধ্য দিয়েই টিকে আছে।
তিন. পাশাপাশি বিদেশী জাতের মধ্যে যা আমাদের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র ব্যবস্থাপনার দিক থেকে উপযোগী তাদের আত্মস্থ করে বাজারের সুবিধাটুকু নিতে সক্ষম হওয়া জরুরী, যা অর্জন না করা গেলে কৃষকদের আর্থিক উন্নতি নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
চার. বিদেশি জাতের বাচ্চা পাওয়া সুলভ হবার কারণে অধিক পরিমানে উৎপাদনের সুবিধাটুকু নেওয়া সহজ হয়। কৃষকের ঘরে বাচ্চা ফুটাবার জন্য সহজ ও ছোট হ্যাচারি বসানোই পরিকল্পনা সফল হলে বাচ্চার জন্য নির্ভরশীল হবার প্রয়োজন থাকবে না।
পাঁচ. কৃষকদের উপযোগী নতুন জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা যাচাই করা ও উদ্ভাবন করা।
প্রাণসম্পদ সংরক্ষণ, বৃদ্ধি ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আর্থিক উন্নতির সঙ্গতি বিধান একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। তার মোকাবিলা খুব সহজ নয়। সেই ক্ষেত্রে নয়াকৃষি অনেকদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। কৃষকদের নেতৃত্বে এই অভিজ্ঞতার বিস্তার ঘটানোই এখনকার কাজ।